ময়দানে বিনা মেঘে বজ্রপাত। শনিবার ভোররাতে চলে গেলেন ভারতবর্ষের কিংবদন্তি ফুটবলার এবং কোচ সুভাষ ভৌমিক (Subhas Bhowmick)। বয়স হয়েছিল ৭১। গত তিন মাস ধরে কিডনির সমস্যায় তাঁর ডায়ালিসিস চলছিল। কিন্তু দিন কয়েক আগে স্নায়বিক সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন একবালপুরের একটি নার্সিংহোমে। কথা ছিল, তাঁকে শনিবার মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। এই নিয়ে শুক্রবার ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ঘরে একটি বৈঠক হয়। কিন্তু সে সবের কোনও প্রয়োজন হল না। সবাইকে পিছনে ফেলে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন চিরদিনই দাপুটে ফুটবলার এবং কোচ সুভাষ ভৌমিক। রেখে গেলেন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, কন্যা ও জামাতাকে।
মালদহ থেকে ফুটবল খেলতে এসেছিলেন কলকাতায় ১৯৬৭ সালে। প্রথম ক্লাব ছিল স্পোটিং ইউনিয়ন। তারপর রাজস্থান হয়ে ইস্টবেঙ্গলে এলেন ১৯৬৮ সালে। দু’বছর ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে মোহনবাগানে চলে গেলেন ১৯৭০ সালে। তিন বছর সেখানে খেলে ১৯৭৩-এ আবার ইস্টবেঙ্গলে। আবার মোহনবাগানে গেলেন ১৯৭৬ সালে। ইস্টবেঙ্গলে ফিরলেন ১৯৭৯ সালে। সেখান থেকেই অবসর। ১২ বছরের বড় ক্লাবের ফুটবল জীবনে তাঁর সেরা সময় ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫। সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে তিনি ভারতবর্ষের সব ক্লাবের বিরুদ্ধে শুধু গোলই করেননি, তাদেরকে তাঁর ফুটবল দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। খেলতেন রাইট উইঙ্গারে। ডান দিক দিয়ে তাঁর দুর্ধর্ষ গতির সঙ্গে ছিল অমানুষিক ক্ষমতা। যেন বুলডোজারের মতো বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের গুঁড়িয়ে চলে যেতেন। এই ফুটবল খেলেই তিনি ভারতের হয়ে ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্চ পদকজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার অধিনায়ক ছিলেন ১৯৭৩ সালে।
আরও পড়ুন : Subhash Bhowmick: সুভাষ ভৌমিকের মৃত্যুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতার শোকপ্রকাশ
কোচ হিসাবে সুভাষ ভৌমিক যাত্রা শুরু করেন ১৯৮৭ সালে। প্রথাগত কোনও ট্রেনিং তাঁর ছিল না। কিন্তু ফুটবল বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের এক নম্বর কোচ হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে ভারতের জাতীয় দল নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন ঢাকায় প্রেসিডেন্স গোল কাপ খেলতে। ১৯৯১ সালে তিনি মোহনবাগান ক্লাবের কোচ হন। খুব একটা সাফল্য পাননি। সে বছরই সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলের কোচ হয়েও ট্রফি আনতে পারেননি। ১৯৯৯ সালে ইস্টবেঙ্গল তাঁকে কোচ করে আনে। কলকাতা লিগ ছাড়া আর কোনও ট্রফি সে বছর তিনি পাননি। কিন্তু ২০০২ সালে যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে আবার কোচ হিসাবে ফিরলেন, তখন ট্রফির আলোতে ভেসে গেল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। প্রথম বছর পাঁচটি ট্রফিতে খেলে পাঁচটিতেই চ্যাম্পিয়ন। পেলেন কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড, নওগাঁ স্বাধীনতা কাপ, ডুরান্ড কাপ এবং জাতীয় লিগ। পরের বছর জাকার্তায় ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন করলেন আর্সিয়ান কাপে। ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল হারাল থাইল্যান্ডের মেক তেরো সাসানাকে। জিতল ৩-১ গোলে। কলকাতায় ফিরে সুভাষ ভৌমিক আবার ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন করলেন কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ এবং জাতীয় লিগে। পরের বছরও তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ। কিন্তু কলকাতা লিগ এবং নেপালের একটি টুর্নামেন্ট ছাড়া তেমন সাফল্য পাননি। তবে ২০০২ থেকে ২০০৫, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কোচ হিসাবে তিনি যে সাফল্য পেয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই। এই ব্যাপারে তিনি অনন্য। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের চার্চিল ব্রাদার্সকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন সুভাষ ভৌমিক। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন কলকাতা ময়দানের এক জ্বলজ্বলে জ্যোতিস্ক। সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি নিভে গেল অকস্মাৎ। ময়দান এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সুভাষ ভৌমিকের প্রয়াণ ভারতীয় ফুটবলের এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি কোনও দিন মিটবে না।
যত দিন ভারতীয় ফুটবল থাকবে, সুভাষ ভৌমিক থেকে যাবেন ভারতীয় ফুটবলের আকাশে এক সূর্যের মতো।