একটা মাঠে ঘটা ঘটনা, একটা দলের চেহারাই বদলে দিতে পারে! পারে। ইউরো কাপ , ডেনমার্ক আর এক ফুটবলার – এর প্রমাণ। সেটা টের পেয়েছেন ডেনমার্ক দলের কোচ কাসপের জুলমান্ড। ওয়ালেসকে প্রি -কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে ম্যাচ শেষে কী বলছেন ডেনিস কোচ , সেটা শোনা যাক। “মাঠে এরিকসনের হার্ট অ্যাটাকের পর আমার চারপাশের দুনিয়াটা আজ বদলে গেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা পুরো অন্য একটা দলে বদলে গেছি। সকলের ভালোবাসা, সকলের আবেগ আমাদের লড়ার বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে।”
একটু পিছনে তাকালেই বুঝতে পারা যায় কোন আবেগ টেনে নিয়ে চলেছে ডেনিস শিবিরকে। এবারের ইউরো কাপ ফুটবলের প্রথম ম্যাচ ডেনমার্কের ছিল ফিনল্যান্ড দলের বিপক্ষে। সেই ম্যাচ গোলশূন্য চলছিল। হঠাৎ মাঠের মধ্যে বল ধরতে গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে যান এরিকসেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন । সতীর্থরা তাঁকে ঘিরে ‘মানব প্রাচীর’ তৈরি করে। মাঠে সকলের থেকে এরিকসনের চিকিৎসা আড়াল করাই ছিল, এই পন্থার কারণ। আর সকলে হয় আতঙ্কে চোখের জল ফেলছিলেন-নতুবা প্রার্থনা সারছিলেন। মাঠের প্রার্থনা কাজে লাগে। সিপিআর পদ্ধতিতে হৃৎপন্দন ফিরে এলে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এরিকসেনকে। জানা যায়, মাঠেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন ১০ নম্বর জার্সির ফুটবলারটি। এরপর অস্ত্রোপচার করে একটি কৃত্রিম যন্ত্র বসানো হয় তাঁর বুকে। এই যন্ত্রটি হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখছে ।
আরও পড়ুন- সফল অস্ত্রোপচার, বাড়ি ফিরলেন এরিকসন
যেদিন হাসপাতাল থেকে এরিকসন বাড়ি ফেরেন তার ঠিক পরদিনই পৌঁছে গিয়েছিলেন ডেনমার্ক ফুটবল শিবিরে। যেখানে ইউরোর জন্য বাকিরা অনুশীলন সারছিল। প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করেন। বুকে জড়িয়ে অভিনন্দন জানান, তাঁকে সেদিন মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিল স্ত্রী, আর দুই সন্তানও। গোটা ফুটবল দল, এরিকসেন পরিবারের সঙ্গে লাঞ্চ করে। দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয় গোটা দল।
ডেনিস দল সেইদিন মাঠের সেই আতঙ্কের ঘটনাটি ঘটার দেড় ঘন্টা পর ম্যাচটি খেলতে নেমে ফিনল্যান্ডের কাছে এক গোলে হেরে যায়। পরের ম্যাচও হেরে যায় বেলজিয়ামের কাছে । সকলে ধরে নিয়েছিল এবার ডেনমার্কের দৌড় শেষ। কিন্তু এরিকসেনের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তাদের মাঝে চলে আসা অন্য টনিকের কাজ করে চলেছে । এরিসেনের জন্য ইউরো চাই – স্লোগানে চাঙ্গা ডেনিস শিবির। গ্রুপ লিগের ম্যাচে রাশিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শেষ ১৬ তে চলে গেছে ডেনমার্ক। তারপর শনিবার আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়েলসের উপর। আবার জয় ৪-০ গোলে। এবার আটের লড়াই টপকে চারে ঢোকার পালা।
আরও পড়ুন – ওয়েলসকে গোলের মালা পরিয়ে ইউরোর শেষ আটে ডেনমার্ক
বদলে গেছে ডেনমার্ক। কোচ নিজেও টের পাচ্ছেন। তাই শেষ ষোলোর ম্যাচ জিতে প্রচার মাধ্যমের সামনে বলেছেন,’ আমরা সারাক্ষণ মনে করি এরিকসেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে। তাই ম্যাচের শুরুতে ওর ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে আমাদের ফুটবলাররা মাঠে গিয়েছিল।’
আমস্টারদামে জোহান ক্রুইফ স্টেডিয়াম ভর্তি সমর্থকদের প্রবল সমর্থনে চার গোলে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেয় ডেনিসরা। চলে গেছে শেষ আটে। দুটি গোল করেন কাসপার ডলবের্গ । একটি করে গোল করেন জোয়াকিম মাহলে আর মার্টিন ব্রাইথওয়াইতে।
এই মাঠেই নাকি শেষবার ক্রিস্টিয়ান খেলে ডেনমার্ক ছেড়ে বিদেশের ক্লাবে খেলতে চলে গিয়েছিলেন। কোচ আবেগঘন ভাবে বলতে থাকেন, ‘আমি সবসময় চাই এরিকসেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাক। কিন্তু এখন ওকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। আমি জানি ও সারাক্ষণ দলের সঙ্গেই আছে।’ দলের অন্যতম ফুটবলার ডলবের্গও একসম়য় আজেক্সে এরিকসেনের সতীর্থ ছিলেন। শেষ ম্যাচে গোল করে তা উৎসর্গ করেছেন বন্ধু এরিকসেনকে। ম্যাচের পর বলেন,’ এখানে দলের হয়ে খেলতে নামবো ভাবিনি। কী উন্মাদনা! এই মাঠ থেকেই আমার খেলা শুরু হয়েছিল। সেই এখানে খেলেই আবার আরেক দৌড় শুরু করলাম। এই দলে থাকাটাই গর্বের ব্যাপার। দারুণ এক দল।’
প্রথম দুটি ম্যাচে ডলবের্গ চূড়ান্ত দলে জায়গা পাননি। দুটি ম্যাচই হেরে গিয়েছিল ডেনমার্ক। রাশিয়া ম্যাচে ৩০ মিনিট খেলার সুযোগ পান। কিন্তু প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে ডলবের্গ শুরু থেকে খেলেন ইউসুফ পুলসেনের চোট থাকায়। গোলও করেন।
এরপর ডেনমার্কের সামনে নেদারল্যান্ডস কিংবা চেক রিপাবলিক। সেই ম্যাচ হবে ৩ জুলাই বাকুতে।
ইউরো কাপে ডেনমার্ক আর এরিকসেন মিলেমিশে একাকার। তাই বোধহয় ওয়েলস দলের পক্ষ থেকে ম্যাচ শুরুর আগে একটি জার্সিতে সকলে সই করে তা এরিকসেনের জন্য ডেনমার্ক দলের হাতে তুলে দেয়।
ডেনমার্ক যদি এবার ইউরো কাপ চাম্পিয়ন হয়, তাহলে তা যে এরিকসেনকে উৎসর্গ করা হবে – তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ছবি:সৌ-টুইটার