মাত্র তিন বছরের মধ্যে ইউরোপীয় ফুটবলে ইতালির চমকপ্রদ অগ্রগতি যেন কল্পনাকেও হার মানাবে। ২০১৮-র বিশ্ব কাপে যে টিমটা কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি তারা একুশের ইউরো কাপে সেমিফাইনালে উঠেছে টানা পাঁচটি ম্যাচ জিতে। সব মিলিয়ে মঙ্গলবার ভারতীয় সময় রাত সাড়ে বারোটায় লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে মাঠে নামার সময় ইতালির সঙ্গে থাকবে টানা পনেরোটি ম্যাচ জেতার অবিশ্বাস্য রেকর্ড। সব মিলিয়ে তারা টানা ৩২টি ম্যাচে অপরাজিত। ঐতিহাসিকভাবে যারা ডিফেন্সিভ ফুটবল খেলার জন্য বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত তারাই এখন মাঠে নামে শুধু জেতার জন্য। ডিফেন্সকে সামলেও কীভাবে পাসের পর পাস খেলে গোলের দরজা খুলে ম্যাচের পর ম্যাচ জিততে হয় তা দেখাচ্ছে রবের্তো মানচিনির এই ইতালি। ফুটবল জীবনে ফরোয়ার্ড ছিলেন মানচিনি। তাঁকে কোচ করার পিছনে কিংবদন্তী ডিফেন্ডার আলসেন্দ্রো কোস্তাকুর্তার একটা বড় ভূমিকা ছিল। ১৯৯৪-এর বিশ্ব কাপ ফাইনাল খেলেছিলেন কোস্তাকুর্তা। যখন দায়িত্ব পান মানচিনি তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি টিমটার খোল নলচে বদলে শুধু জেতার জন্যই মাঠে নামবেন।
কথা রেখেছেন মানচিনি। তবে ডিফেন্সের দুই স্তম্ভকে বদলাননি। প্রায় দশ বছর ইতালির দুই সেন্টার ব্যাক জিওর্জিও চিয়েলিনি এবং লিওনার্দো বোনুচি পাশাপাশি খেলছেন। তাঁদের ডান পাশে কিংবা বাঁ পাশে ডিফেন্ডার পরিবর্তন হলেও তাঁরা ঠিক মানিয়ে নেন। যেমন কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়াম ম্যাচের শেষ দিকে লেফট ব্যাক লিওনার্দো স্পিনাজোলা চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। চোট সারাতে তিনি চলে গেছেন ফিনল্যান্ডে। জানা গেছে অপারেশনের পর মাঠে ফিরতে ছয় মাস লাগবে এই রোমা ডিফেন্ডারের। স্পেনের বিরুদ্ধে তাই মাঠে নামবেন জিওভানি ডি লরেঞ্জো। রাইট ব্যাকে খেলবেন এমার্সন পেলমিয়েরি। এই পরিবর্তন নিয়ে মানচিনি কি ভাবিত? মনে হয় না।
আসলে ডিফেন্স নয়, তাঁর আসল শক্তি হল মাঝ মাঠ যেখানে ব্রাজিলজাত জর্জিনহোর পাশে খেলবেন নিকোলা বারেলা এবং সম্ভবত মার্কো ভেরাত্তি। তবে তৈরি আছেন ম্যানুয়েল লোকাতেল্লিও। তবে যাঁরাই খেলুন না কেন তাঁদের লড়াই স্প্যানিশ মাঝ মাঠের সঙ্গে। লুই এনরিকের স্পেনও তিন মিডফিল্ডারের খেলছে। অধিনায়ক সের্গেই বুস্কুয়েতের সঙ্গে খেলছেন পেদ্রি গঞ্জালেজ এবং কোকে। ২০১২ সালে ইউরো ফাইনালে ইতালিকেই ৪-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন। সেই টিমেও ছিলেন বুস্কুয়েত। স্পেনের এই টিমে জর্ডি আলবাও সেবার ছিলেন বুস্কুয়েতদের সঙ্গী। তবে চার বছর পরে ২০১৬-র ইউরোতে ইতালি কিন্তু প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল। এখন অবশ্য দু্ই দলের মাঝ মাঠের মধ্যে স্পেনকেই একটু হলেও এগিয়ে রাখতে হবে। তাদের তিনজনের মধ্যে সেরা পেদ্রি। বার্সেলোনার এই মিডিও এবারের ইউরোর অন্যতম সেরা। তাঁর পাশে দুর্দান্ত খেলছেন আটলেটিকো মাদ্রিদের কোকে। ইতালি যেমন পাসের বন্যা বওয়াচ্ছে, স্পেনও তেমনি পাসিং ফুটবলের জন্য বিখ্যাত। এখানে কে কাকে টেক্কা দেয় তাই দেখার।
স্পেনের এই মাঝ মাঠের পিছনে আছে তাদের ব্যাক ফোর। সেন্টার ব্যাকে এরিক গার্সিয়ার সঙ্গে আয়মেরিক লাপোর্তে। এই লোপোর্তে আদতে ফ্রান্সের মানুষ। স্পেনের হয়ে খেলবার প্রস্তাব পেয়ে নাগরিকত্ব বদলে চলে এসেছেন বার্সেলোনায়। তাঁদের ডান দিকে খেলবেন সিজার আজপিলিকুয়েতা। আর বাঁ দিকে জর্ডি আলবা। গোলে উনাই সিমন। এক নম্বর গোলকিপার দাভিদ দাখেয়াকে বসিয়ে খেলছেন আতলেতিকো বিলবাওয়ের এই গোলকিপার। স্পেনের সেমিফাইনালে যাওয়ার পিছনে এই গোলকিপারের বড় ভূমিকা আছে। স্পেনের ডিফেন্স ইতালির মতো অভিজ্ঞ না হলেও যথেষ্ট মজবুত।
কিন্তু ম্যাচ জেতাবার জন্য তো গোল করতে হবে। এই ব্যাপারে, মনে হয়, স্পেনের চেয়ে ইতালি বেশ খানিকটা এগিয়ে। তাদের সিরো ইম্মোবাইল এবং লরেঞ্জো ইনসিগ্নের সঙ্গে হয়তো খেলবেন ফেদরিকো চিয়েসা। এই তিনজনের কম্বিনেশন কিন্তু স্পেনের আলভারো মোরাতা, ফেরান টোরেস এবং ড্যানি ওলমোর কম্বিনেশনের চেয়ে অনেক ভাল। স্পেন হয়তো পাবলো সারাবিয়াকে পাবে না। সুইৎজারল্যান্ড ম্যাচে তাঁকে বিরতির আগে তুলে নেওয়া হয় চোটের জন্য। প্রথম দুটি ম্যাচে জয়হীন স্পেন তৃতীয় ম্যাচে পাঁচ গোল করেছে। প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে তারা নির্দ্ধারিত সময়ে ৩-৩ করেছিল ক্রোয়াশিয়ার সঙ্গে। পরে অতিরিক্ত সময়ে ৫-৩ জেতে। ইতালিকে অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের মতো টিমকে হারাতে হয়েছে। বিরতির আগেই ইতালি দুটো গোল করে ফেলে শেষ পর্যন্ত ২-১ জেতে। ইতালির স্ট্রাইকারদের ভেদশক্তি স্পেনের চেয়ে অনেক ভাল। কোয়ার্টার ফাইনালে সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে স্পেনকে জিততে হল টাই ব্রেকারে। শুরুতেই গোল পেয়ে গিয়েও স্পেন কিন্তু সেই গোল রাখতে পারেনি। ৭৭ মিনিটে সু্ইসরা দশ জনে হয়ে গেলেও ম্যাচ জিততে হল টাই ব্রেকারে। তাই ইতালির মতো স্পেনের স্ট্রাইকাররা কিন্তু সেভাবে গোলের মধ্যে নেই।
সব মিলিয়ে তাই ইতালিকে একটু হলেও এগিয়ে রাখতে হবে। তবে স্পেন যে পাশা উল্টে দিতে পারবে না তাই বা কে বলবে?