মুম্বই সিটি এফ সি-৫ এটিকে মোহনবাগান–১
(বিক্রম প্রতাপ সিং-২, ইগর অ্যাঙ্গুলো, মোর্তাদা ফল, বিপিন সিং) (ডেভিড উইলিয়ামস)
কলকাতা মাঠে একটা চালু প্রবাদ আছে। তা হল ডার্বি জেতার পরের ম্যাচটা জেতা খুব কঠিন। সত্তর-আশি-নব্বই দশকে মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল ডার্বি জেতার পর ম্যাচ হেরে ঘরে ফিরেছে এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। দেখা যাচ্ছে শতাব্দী পেরিয়ে মোহনবাগান যখন এটিকের সঙ্গে যুক্ত হল, তখনও সেই হুডু তাদের পিছনে ছাড়ল না। আই এস এল-এ মুম্বই সিটি এফ সি গত বছর থেকেই মোহনবাগানের শনি হয়ে দেখা দিচ্ছে। গত বার তারা কলকাতার দলটাকে পর পর তিন বার হারিয়েছে। বছর ঘুরেও মোহনবাগানের দুর্দশা কাটল না। এবার অবশ্য হারটা শুধু হার নয়, যাকে বলে গোহারা হার। লজ্জার এক শেষ। মোহনবাগানের মতো দল পাঁচ গোল খেয়ে হারছে এটা অকল্পনীয়।
তবে সত্য ঘটনা তো সব সময়েই কল্পনাকে হার মানায়। মোহনবাগানের ক্ষেত্রেও তাই হল। চার মিনিটের মধ্যে সেই যে গোল খাওয়া শুরু হল তার পর যেন আর বিশ্রাম নেই। বিরতির আগেই ৩-০। বিরতির পর সাত মিনিট যেতে না যেতেই আরও দুটো গোল। আগের দিন ইস্ট বেঙ্গলও ছয় গোল খেয়েছিল ওড়িশার কাছে। কিন্তু জঘন্য ফুটবল খেলেও ইস্ট বেঙ্গল তবু চারটে গোল করেছিল। কিন্তু মোহনবাগান? এক এক দিন এ রকম হয়। সেই ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আই এফ এ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান পাঁচ গোল খেয়েছিল ইস্ট বেঙ্গলের কাছে। তার পর আবার এ রকম কেলেঙ্কারির ম্যাচ। তবে সে ম্যাচে মোহনবাগানের কেউ লাল কার্ড দেখেনি। বুধবার মারগাওয়ের ফাতোরদা স্টেডিয়ামে মোহনবাগান কিন্তু বিরতির পরেই দশ জনে হয়ে যায়। বিক্রম সিংকে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন সেন্টার ব্যাক দীপক ট্যাংরি। পর পর দুটো ম্যাচে জেতার পরেও বাগান কোচ আন্তোনিও হাবাস বলেছিলেন তাঁর টিমের ডিফেন্স নিয়ে সমস্যা আছে। কিন্তু সেটা যে এভাবে তাঁর টিমকে ডোবাবে তা মনে হয় তিনি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। তাঁর দুই সাইড ব্যাক প্রীতম কোটাল ও শুভাশিস বসুকে জঘন্য বললেও খুব কম বলা হয়। আই এস এল-এ প্রীতমের এটা শততম ম্যাচ ছিল। তিনি বা তাঁর দল যা খেলল তাতে ম্যাচটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে পারবেন বলে মনে হয় না। আর শুভাসিশ? ইস্ট বেঙ্গলকে তিন গোল দেওয়ার পরেও ট্রোল্ড হয়েছিলেন। এদিনের ম্যাচের পর ট্রোল্ড হলে কেউ কিছু বলতে পারবে না।
মোহনবাগানে ডিফেন্স তো বটেই, এই হারের জন্য তাদের মাঝ মাঠও দায়ী। জনি কাউকো, লেনি রডরিগসেদের কোনও প্রতিরোধ ছিল না মাঝ মাঠে। আর মুম্বই-এর নতুন কোচ ডেসমন্ড বাকিংহাম ব্রিটিশ হলেও খেললেন পাসিং ফুটবল। মাত্র ৩৬ বছর বয়স এই কোচের। পাস, পাস আর পাস। এই পাসের ঘনগটায় চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেন প্রীতম কোটাল এবং তার সতীর্থরা। আর পাস খেলার সঙ্গে মুম্বইয়ের ছিল উইং প্লে। ডান দিকে বিক্রম প্রতাপ সিং আর বাঁ দিকে বিপিন সিং। এই বিক্রম প্রতাপ পঞ্জাবের ছেলে। বয়স মোটে ২২। এটাই তাঁর প্রথম আই এস এল। আর বিপিন সিং হলেন মণিপুরের ছেলে। গত বছরের আই এস এল ফাইনালে মোহনবাগানের জালে বলটা তিনিই জড়িয়েছিলেন। এদিনও একটা গোল করলেন। তবে জোড়া গোল করে সঙ্গত কারণেই ম্যাচের সেরা বিক্রম প্রতাপ সিং।
দ্রুত লয়ের পাস এবং দুরন্ত উইং প্লে-তেই মুম্বই বাজিমাৎ করল। তাদের টিমে তিনজন নেতা আছেন। ডিফেন্সে মোর্তাদা ফল, মাঝ মাঠে আহমেদ জাহু এবং ফরোয়ার্ডে ইগর অ্যাঙ্গুলো। এই তিনজনের নেতৃত্বই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিল। এই জায়গায় মোহনবাগানের সবাই ব্যর্থ। মাঝ মাঠে জনি কাউকো, হুগো বুমো কিংবা দুই উইঙ্গার মনবীর এবং লিস্টন কোলাসোকে এদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেভাবে বল না পেয়ে রয় কৃষ্ণও সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ালেন। তবে বিরতির পর মাঠে নেমে খানিকটা পড়ে পাওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা গোল করলেন ডেভিড উইলিয়ামস।
চার মিনিটেই প্রথম গোল খায় মোহনবাগান। বাঁ দিক থেকে বিপিন সিং-এর সেন্টার ইগর আ্যাঙ্গুলো ফলস দিয়ে ছেড়ে দিলেন। সেই বলটা বিনা বাঁধায় গোল করে গেলেন বিক্রম সিং। ২৫ মিনিটে দ্বিতীয় গোলটাও তাঁর। এবারও সেই বাঁ দিক থেকে বিপিনের সেন্টার। তবে মাঝ খানে অ্যাঙ্গুলো ছিলেন না। বিক্রমের শট অমরিন্দর বাঁচালেও তাঁর বুক থেকে বল বেরিয়ে আসে। এবং বিক্রম আবার গোলে ঠেলে দেন। এত ক্ষণ ইগর অ্যাঙ্গুলো দেখছিলেন। এবার তাঁর মনে হল, তিনিই দলের এক নম্বর স্ট্রাইকার। তাঁর তো একটা গোল করা দরকার। বাঁ দিক থেকে কর্নার। বলটা বাগান ডিফেন্স ক্লিয়ার করলে বল গেল বক্সের বাইরে থাকা মন্দার দেশাইয়ের কাছে। তাঁর লব খুঁজে নিল মোর্তাদা ফলের মাথা। আলতো হেডে বলটা ফাঁকায় দাঁড়ানো অ্যাঙ্গুলোকে দিলেন ফল। আলতো পুশে গোল। ম্যাচের বয়স তখন ৩৮ মিনিট।
বিরতির পর প্রথম মিনিটেই লাল কার্ড দেখতে হল দীপক ট্যাংরিকে। ৪৮ মিনিটে আহমেদ জোহুর লব ঠিক খুঁজে নিল মোর্তাদা ফলের মাথা। বাগান ডিফেন্স ফুঁড়ে বেরোলেন মোর্তাদা ফল। হেড এবং গোল। চার মিনিট যেতে না যেতেই বিপিন সিং গোল করে গেলেন। বাঁ দিক থেকে ছুটে এসে দুই ডিফেন্ডারকে ঘাড়ের উপর নিয়েও বাঁ পায়ের শটে গোল। এর পর ৬০ মিনিটে উইলিয়ামসের গোল ব্যবধান কমালেও ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
ইস্ট বেঙ্গলের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কিন্ত মোহনবাগান তো ভাল দল। এখনও সতেরো ম্যাচ বাকি। আশা করা যায় এটাকে একটা দুর্ঘটনা ধরে নিয়ে মোহনবাগান আবার ঘুরে দাঁড়াবে।