মাঠ থেকে নেইমারের মতো একজন খেলোয়াড় উঠে যাচ্ছেন,যেকোনো প্রতিপক্ষ দলের কাছেই এটা পরম স্বস্তিদায়ক এক বিষয়। কিন্তু নেইমারের জায়গায় যদি লিওনেল মেসির মতো কাউকে মাঠে নামান হয়,সেই স্বস্তির কতটুকুই বা অবশিষ্ট থাকে?
এমন অবস্থাতেই রবিবার পড়েছিল রেঁস। পিএসজির জার্সি গায়ে এই ম্যাচেই যে ক্লাব ম্যাচ খেলতে দেখা যাবে,এটা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিল। নিশ্চিত ছিল না মেসির মাঠে নামার সময়টা। সেটাও ঘটে যায় । রেঁসের বিপক্ষে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে পরিবর্ত হয়ে খেলতে নামা দিয়েই পিএসজির হয়ে দৌড় শুরু করে ফেললেন লিওনেল মেসি। ম্যাচের ৬৬ মিনিটে প্রিয় বন্ধু নেইমারের জায়গাতেই মাঠে নেমেছেন মেসি। ম্যাচের বাকি সময়টায় খেলেছেন এমবাপ্পে ও আনহেল দি মারিয়ার সঙ্গে।
মেসির অভিষেকের ম্যাচে যাবতীয় নজর কেড়ে নিয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। রিয়াল মাদ্রিদে এরই মধ্যে চলে যাবেন হয়তো। যদি চলেই যান, তাহলে মেসির সঙ্গে এই এক ম্যাচেই খেলার সুযোগ পেয়ে গেলেন এমবাপ্পে। ঐতিহাসিক মূহুর্তটা জোড়া গোল করে স্মরণীয় করেছেন এই ফরাসি স্ট্রাইকারটি । তাঁর জোড়া গোলেই রেঁসকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে পিএসজি।
রিজার্ভ বেঞ্চে বসে মেসি। মাঠে নামার অপেক্ষায়।
মেসি ম্যানিয়া:
নিজেদের দল ম্যাচ হারছে, তাতে কি! লিওনেল মেসির মতো একজন বিশ্ব তারকা ফুটবলারের খেলা মাঠে বসে স্বচক্ষ্যে দেখা যাচ্ছে, সেটাই যেন বিশাল পাওনা। রেঁসের স্তাদ অগোস্ত-দোলন স্টেডিয়ামে খেলতে নেমেছিল দুই দল। মেসি যখন নামলেন, মনেই হলো না পিএসজি অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে এসেছে! গোটা মাঠ কেঁপে উঠল ‘মেসি’, ‘মেসি’ চিৎকারে। রেঁসের মানুষ কোনোদিনই হয়তো ভাবেননি, মেসি এই ক্লাবের মাঠে ফুটবল খেলতে আসবেন। চোখের সামনে মেসিকে ক্লাব ফুটবল খেলতে দেখা যাবে।
প্রতিপক্ষের ভেন্যু রেঁসের স্তাদ অগোস্ত-দোলন স্টেডিয়ামে আসা গ্যালারিভর্তি দর্শকরা আর যেন অপেক্ষায় বসে থাকতে পারছিল না। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে করতালির দিয়ে আরেকবার বরণ করে নিয়েছেন দিনের প্রতিপক্ষ পিএসজির নায়ককে।
তিনি মাঠে নামছেন, এই খবরেই ম্যাচের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এদিন, বিশ্ব ফুটবলের সকলের নজর ছিল একজনের দিকে- তিনি মেসি। বার্সেলোনা থেকে প্যারিসে নাম লেখানোর পর এদিনই যে পিএসজির হয়ে অভিষেক ম্যাচে অতিরিক্ত ৬ মিনিটসহ খেলেছেন মাত্র ৩১ মিনিট। আর তাতেই ফরাসি লিগের ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছেন এই মেগা স্টার।
পিএসজির জন্য যেন সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিল। রেঁসের মানুষজনের তো অমনভাবে আবেগে ভাসা স্বাভাবিক! জানি না,পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে মাঠে নামতে দেখে ঘরের দর্শকেরা এমনভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে কি না। গুগলও গুলিয়ে ফেলছে! মেসি যে রেঁসের হয়ে খেলেন না, ম্যাচ শেষে তো সেটা আরও একবার বোঝাই গেল না। দলবেঁধে রেঁসের খেলোয়াড়েরা ছবি তুলতে লাগলেন মেসির সঙ্গে।
প্রতিপক্ষের দলের গোলরক্ষক তাঁর ছোট্ট ছেলেকে মেসির কোলে দিয়ে ছবি তুলে রাখলেন।
প্রতিপক্ষ রেঁসের সার্বিয়ান গোলকিপার প্রেদ্রাগ রাইকোভিচ আগে থেকেই পরিকল্পনা করেই রেখেছিলেন। নিজের শিশুপুত্রকে এ দিন মাঠে নিয়ে এসেছিলেন। রাইকোভিচ ম্যাচ শেষে ছেলেকে তুলে দিয়েছিলেন মেসির কোলে, তুলেছেন ছবিও। রাইকোভিচের ছেলে বড় হয়ে এই ছবি দেখলে নিশ্চয়ই বাবাকে বারবার ধন্যবাদ দেবে!
এমবাপ্পের দাপট:
পিএসজিকে আরেকবার জিতিয়ে এমবাপ্পে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। দলবদলের বাকি আছে আর মাত্র দুই দিনেরও কম সময়। তাঁর জন্য রিয়াল মাদ্রিদের ১৮ কোটি ইউরোর প্রস্তাব এখনও পিএসজির টেবিলে। মোটামুটি সব নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমই বলছে, এমবাপ্পের রিয়াল-যাত্রা নিশ্চিত। এই পারফরম্যান্স দেখার পর শেষ মুহূর্তে পিএসজি যদি এমবাপ্পেকে ছাড়তে না চায়,দোষ দেওয়া যায় না তাঁদের!
কখন নামবেন মেসি? ম্যাচের ৬৫ মিনিটে শেষ হয় সেই অপেক্ষার। মাঠে নামেন বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা। যদিও ম্যাচে তার আগেই অবশ্য জোড়া গোল করে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছেন এমবাপ্পে।
নেইমার, এমবাপ্পে আর মেসির ত্রিধারার ফুটবল দেখার সুযোগ মিললো না এই ম্যাচে।
রেঁসের বিপক্ষে ৪-৩-৩ ছকে প্রতিপক্ষের মাঠে নেমেছিল মাওরিসিও পচেত্তিনোর দল। গোলকিপার কেইলর নাভাসের সামনে দুই সেন্টারব্যাক হিসেবে ছিলেন ব্রাজিলের মার্কিনিওস ও জার্মানির থিলো কেহরার। ওদিকে রাইটব্যাক হিসেবে আছেন নতুন আসা আশরাফ হাকিমি, লেফটব্যাকে আবদু দিয়ালো। মাঝমাঠ আলো করেছেন ইতালির মার্কো ভেরাত্তি, সেনেগালের ইদ্রিদা গানা গেয়ে ও এই মরসুমেই লিভারপুল থেকে আসা জর্জিনিও ভাইনালডম। আক্রমণভাগে এই মরসুমে প্রথমবারের মতো পিএসজির হয়ে এই ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন নেইমার। সঙ্গে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ও কিলিয়ান এমবাপ্পে। শুরু থেকে মেসি ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে।
রিয়াল বার্তা:
এমন ম্যাচে এমবাপ্পের উজ্জ্বল উপস্থিতি নিঃসন্দেহে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের যাবতীয় ভাবনার ভিত নাড়িয়ে দিল । বেশ কদিন ধরেই এমবাপ্পে পি এস জি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেবেন বলে জোর জল্পনা। এমনকি এমবাপ্পের জন্য ১৮ কোটি ইউরোর বড় অর্থের এক প্রস্তাবও পাঠিয়ে রেখেছে পিএসজির কাছে । এমন পরিস্থিতিতে কোথায় তিনি দলবদলের বাকি কাজগুলো সারবেন, তা না করে মাঠে নেমে গোল করে পি এস জি- কে জিতিয়ে চলেছেন এই তারকাকে। দলবদলের বাকি আছে আর মাত্র দুদিন। ক্লাব দলবদলের এই পর্বে আদৌ এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেল। পি এস জি তাঁকে প্রথম দলে রাখছে। গুরুত্ব দিচ্ছে, তাহলে এমন দল কেন ছাড়বেন? শুধু অর্থের জন্য? সকলের আর ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এমবাপ্পে যদি রিয়ালে চলেই যান, তাহলে একটি আক্ষেপ রয়ে যাবে গোটা ফুটবল বিশ্বের। সেটা হল, একই ক্লাবের জার্সিতে একসঙ্গে মাঠে মেসি-নেইমার-এমবাপ্পের খেলা দেখা। ক্লাব দলবদল শেষ হবার আগে এটাই যে ছিল একমাত্র ম্যাচ, যেখানে এই তিন মহারথীকে দেখার সুযোগ হতে পারতো। কিন্তু ম্যাচে মেসি তো নেমেছিলেন বন্ধু নেইমারের বদলি হিসেবে! ত্রিমূর্তির বল পায়ে ‘ফুটবল’ এই ম্যাচে একসঙ্গে হল কই!
ম্যাচে নেইমারের পরিবর্তে নামলেন মেসি।
ম্রিয়মাণ নেইমার :
কোপা আমেরিকার ফাইনালে খেলার প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় পর খেলতে নেমেছিলেন নেইমার। প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে সেভাবে নজর করতে পারেননি ব্রাজিলিয়ান তারকাটি। সারাক্ষণ ‘অ্যাওয়ে ম্যাচে’ গ্যালারি থেকে ভেসে আসছিল প্রিয় তারকার নামে ‘মে-সি,মেসি,মে-সি…’ চিৎকার। এমন চিৎকার থামল ম্যাচ শেষে মেসির মাঠ প্রদক্ষিণের পর। হোম ম্যাচ নয়, তা সত্ত্বেও ম্যাচ শুরুর আগেই এ যেন মহানায়কের প্যারিস বরণ!
ছবি: সৌ টুইটার