সাত সকালে টুইটার অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়েই একের পর এক টুইট লিংক চোখে পড়তে শুরু করলো। পরেই যাচ্ছি পরপর। ভারত – পাক সীমান্তের এপার ওপার তো টুইটারে রোখা যায় না। বিশ্বব্যাপী ভাবনাকেও রোখা যায়না। আমার ভাবনাকেও রুখতে পারলাম না!
ইস্যু: কে পি এল (KPL)। কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগ। পাকিস্তানের অধীনে থাকা কাশ্মীর।
অভিযোগ: ‘এই টুর্নামেন্টে যেন অংশ না নিই, তাই হুমকি দিচ্ছে বিসিসিআই সচিব জয় শাহ’: হার্শেল গিবস ( প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার, দক্ষিণ আফ্রিকা) ।
‘বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট সংস্থার কর্তাদের হুমকি দিচ্ছে। কেপিএলে কোনও প্রাক্তন ক্রিকেটার যুক্ত হলে, ভারতে তাদের আর ঢুকতে দেওয়া হবে না’: রশিদ লতিফ ( প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার, পাকিস্তান)
পাকিস্তানের কেউ এমন অভিযোগ আনছেন, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনা মনে জায়গা পায়নি। বরঞ্চ ঢের বেশি ভাবনায় ফেলে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবস। তাঁকে কেনো আটকানোর চেষ্টা করবো বিসিসিআই! এই গিবস দশ বছর হল, অবসর নিয়েছেন। এখন বিভিন্ন দেশে কোচিং করান। তাতে আপত্তি কেন!
দেখতে পেলাম কাতার থেকে প্রচারিত আন্তর্জাতিক ইংলিশ নিউজ চ্যানেল আলজাজিরা তাদের টুইটার হ্যান্ডেলে ইস্যুটিকে গুরুত্বও দিয়েছে। টিভিতে চ্যানেলটিতে কি দেখানো হচ্ছে – তা দেখব বলে, রিমোট নিলাম হাতে। দেখি, চ্যানেল তো হেডলাইনে বসিয়ে দিয়েছে! আর হার্শেল গিবসের ফোনে নেওয়া ইন্টারভিউ চালাচ্ছে। গিবস বলেছেন, ‘দ. আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর গ্রেম স্মিথকে নাকি বার্তা পাঠিয়েছেন মি. শাহ নামে বিসিসিআইয়ের একজন সেক্রেটারি। সেখানে গিভসকে কাশ্মীর লিগ খেলতে নিষেধ করা হয়েছে।’
এ কী শুনছি! প্রথমবার পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীর লিগ ঠেকাতে বিদেশি ক্রিকেটারদের হুমকি দিচ্ছে ভারত! থুড়ি – ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড! বিসিসিআই?
কিছু ফোনে আর কিছু সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যম ব্যবহার করে জানলাম – পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এই প্রথমবার শুরু হতে যাচ্ছে কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট (কেপিএল)। যেখানে খেলবেন ইংল্যান্ড ও শ্রীলংকার ছয়জন বিদেশি তারকা। আর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকছেন হার্শেল গিবসের মতন প্রাক্তনীরা।
আর এইসব বিদেশি ক্রিকেটারদের নাকি কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগ না খেলার জন্য হুমকি দিচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কয়েকজন কর্মকর্তা।
আগামী ৬ আগস্ট থেকে কাশ্মীরে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত মুজাফফরাবাদে এ টুর্নামেন্টেটি হতে চলেছে। এবারের প্রথম টুর্নামেন্টে নিজেদের ক্রিকেটাররা ছাড়াও মাঠ মাতাতে হাজির থাকার কথা ক্রিকেটের প্রাক্তন সুপারস্টারদের।
এই তালিকায় আছেন – দক্ষিণ আফ্রিকার একসময়কার মারকুটে তারকা ব্যাটসম্যান হার্শেল গিবস, ইংল্যান্ডের তারকা মন্টি প্যানেসার, ফিল মাস্টার্ড ও ওয়াইজ শাহ এবং শ্রীলংকার প্রাক্তন অধিনায়ক তিলকারাত্নে দিলশান।
ছটি দলকে নিয়ে হবে এবারের টুর্নামেন্টটি। যেখানে সবগুলো দলের অধিনায়ক রাখা হয়েছে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। একটি দলের অধিনায়কত্ব করবেন পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি। একটিতে আবার অধিনায়ক এখনকার পাক দলের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার মহম্মদ হাফিজ। বাকি চার দলের নেতৃত্ব দেবেন – পাক অলরাউন্ডার শোয়েব মালিক, ফখর জামান, শাদাব খান ও ইমাদ ওয়াসিম।
বিসিসিআইয়ের এমন আচরণ নিয়ে শনিবার এক টুইটে হার্শেল গিভস লিখেছেন, ‘কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগে ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক কোনও ইস্যুকে জড়িয়ে দেওয়া মোটেই উচিত নয়। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড বিসিসিআই এমনটা করছে। আমাকে তারা হুমকি দিয়েছে যে, যদি আমি কেপিএলে অংশ নেই তো তারা কখনও আমাকে ভারতে প্রবেশ করতে দেবে না।’
গিবসের টুইটারের একদিন আগেই এই ইস্যুকে সামনে এনে রশিদ লতিফও বিসিসিআইয়ের বিপক্ষে লেখেন। ‘বিসিসিআই বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডকে হুমকি দিচ্ছে, তারা যদি প্রাক্তন ক্রিকেটারদের কাশ্মীরে খেলার অনুমতি দেয়, তাহলে তাদের আর ভারতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। গিবস, দিলশান, প্যানেসারসহ অনেকেই কাশ্মীরের লিগে খেলবেন।’
প্রাক্তন এই দক্ষিণ আফ্রিকার মারকুটে ওপেনার এখন ব্যস্ত কোচিং নিয়ে। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি লিগে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গিবস এই কে পি এলে নতুন এক দায়িত্ব পেয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে চলা কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগেও যোগ দেওয়ার কথা তাঁর। লিগের একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি দল — ওভারসিজ ওয়ারিয়র্সের দায়িত্ব পেয়েছিলেন গিবস।
এর পাশাপাশি রশিদ লতিফের অভিযোগটিও নাকি সত্য। এই বলে মন্তব্য করে কেপিএলের এক প্রতিনিধি মন্তব্য করেছেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডকে তাদের প্রাক্তন ক্রিকেটারদের আটকানোর কথা বলেছে বিসিসিআই। বোর্ডগুলো বিসিসিআইয়ের আবেদন মেনেও নিয়েছে। তাই এখন বিদেশি ক্রিকেটারদের বদলে স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিতে হবে।’
গিভস ও রশিদ লতিফের এমন অভিযোগের বিষয়ে বিসিসিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রতিনিধি প্রথমেই মেনে নিয়েছেন, তারাও এমনটা শুনেছেন। কিন্তু সত্যি মিথ্যা জানেন না। পাশাপাশি তাঁরা এটাও বলেছেন, ‘বিসিসিআই তো দেশের ক্রিকেট পরিচালনা করে, এই দেশে কে বা কারা ঢুকতে পারবেন, সে তো বিদেশ মন্ত্রক আর স্বরাষ্ট্র দপ্তর দেখবে। বিসিসিআই নয়।’
ঠিকই বলেছেন ওঁরা। কিন্তু শোনা যাচ্ছে বিসিসিআই সচিব জয় শাহের নাম। যিনি আবার দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে। তবে কি ধরে নিতে হবে, পররাষ্ট্র নীতিতে ক্রিকেটও ব্যবহৃত হচ্ছে! নাকি কাশ্মীর ইস্যু বলেই ক্রিকেটকেও হাতিয়ার করা হচ্ছে!
এই ইস্যুতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডও ঢুকে পড়েছে। তারা আবার ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংস্থা আর এস এসের হাত দেখতে শুরু করেছে, এসবের মধ্যে। তারা সুর উঁচিয়ে বলেছে,’বিসিসিআইয়ের এমনসব কাজকর্ম মেনে নেওয়া যায়না। ক্রিকেট স্পিরিটকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটা সহ্য করাও যায় না, আবার গুরুত্বহীন বলেও সরিয়ে রাখা যায় না। এমনকি পাক বোর্ড কর্তারা এমন স্পর্শকাতর বিষয়কে আইসিসি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইছে।
কে পি এল’র ক্রিকেট অপারেশন ডিরেক্টর তৈমুর খানের বক্তব্য পড়লাম। উনি বলেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এমন হুমকির কথা তিনি শুনেছেন। তবে সঠিক সময়েই এই টুর্নামেন্ট শুরু হবে বলেছেন। তিনি দাবী করেছেন, ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড কর্তাদেরও বিসিসিআই থেকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে।
দেশ – বিদেশের প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতে আসার জন্য দুটি কাজ পান। এক, নানান ভূমিকায় আই পি এলে অংশ নেওয়া। আর দুই, টিভি ধারাভাষ্যকার হয়ে কাজ করা। প্রত্যেকে জানেন, এই ধরনের কাজে মোটা অর্থ মেলে। তাই অনেক ক্রিকেটার ভারতে আসা বন্ধ হতে পারে শুনে পিছিয়ে গেছেন।
প্রশ্ন হল, এই অভিযোগ সত্যি হলে – কোনও দেশের বোর্ড কি পারে প্রাক্তন কোনও ক্রিকেটারের উপর এই ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করতে? তাহলে জেনে শুনে এমন কাজ কেন বিসিসিআই করতে গেলো!
তাহলে কি ধরে নিতে হবে, পাকিস্তান ইস্যুতে ভারত সরকার আর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এক সঙ্গে পা ফেলছে! আর তা যদি হয়, পররাষ্ট্র নীতিই হোক আর কূটনীতিই হোক – ক্রিকেট কিন্তু স্বচ্ছতা হারাতে চলেছে।
মনে আছে, এই ক্রিকেটার হাত ধরেই ( বোর্ড সচিব এবং সভাপতি ছিলেন সেই সময় প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া) কিন্তু বার বার সব টেনশন সরিয়ে দুই দেশ কাছে এসেছিল। এবারের এই ‘কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগ’ ইস্যু অন্য বার্তা বয়ে আনছে না তো?
ছবি: সৌ – টুইটার।