সেঞ্চুরিয়ান জয় ২০ বছরেরও নজির সরিয়ে নুতন মাইলস্টোন সামনে এনে দিল। কোহলির দল হল দ্বিতীয় দল যারা দুই দশকে এই মাঠে হোম টিমকে হারাল। সাবাশ। বিপক্ষের ২০ টি উইকেট চাই। ৫ বোলার চাই দলে। এমন জয় নিয়ে ম্যাচ শুরুর আগে কারোর সংশয় ছিল না।
এশিয়ার কোনও দল দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা দিয়ে শুরু করছে জয় দিয়ে, এটা তো প্রায় শোনাই যায় না। সেই সেঞ্চুরিয়ানে ভারতের ১১৩ রানে জয়, দারুণ কিছু সাফল্য বলে ধরা হচ্ছে না! বরঞ্চ টিম ইন্ডিয়া বা দলের সমর্থকরা এটাকে ‘আরও একটা জয়’ বলে ধরে নিয়েছে। এ যেন রোজকার অফিস করার মতন ব্যাপার!
মানছি, প্রতিপক্ষ সেই দুর্দান্ত দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো নয়। কিন্তু নিজেদের দেশে সকল দলই ‘বাঘ’। ‘বেড়াল’ বনে বিদেশে। এই ম্যাচের পাঁচটা দিন দলটাকে দেখে মনে হল, এটিই বুঝি সেরা ভারতীয় টেস্ট দল। উইকেট নিলে সিরাজের ‘সি আর সেভেনে’ এর মত সেলিব্রেশন স্টাইল মানানসই লেগেছে। পা মচকে গিয়ে মাঠে ফিরে বুমরার উইকেট নেওয়ার খিদে, শামির প্রতি মুহুর্তে নিজেকে আরও ছাপিয়ে যাওয়ার ফাঁকে – স্পিনার হয়েও উইকেট নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া অশ্বিনকে দেখে মনে হচ্ছে – ২০২২ বুঝি ভারতের সাফল্যের ঝাঁপিতে আরও কিছু ভরতে চলেছে।
বিদেশের মাটিতে সাফল্যের জোয়ার।
শুরুর সাফল্য,শেষেও সাফল্য:
২০২১ শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চিত্তাকর্ষক জয় দিয়ে। আর শেষ হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে জয় দিয়ে। বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কেবিনে শুয়ে শুয়ে টিভিতে জয় দেখেছেন। তারপর টুইট করে লিখেছেন – এমনই কিছু কথা। তিনিও মুখিয়ে ২০২২ এর টিম ইন্ডিয়াকে সাফল্যের শিখরে দেখতে।
মানতেই হবে বছর শুরুর গাব্বার জয় আর সেঞ্চুরিয়ানের জয়ে ফাঁরাক আছে। গাব্বায় কেউ ভারতীয় দলকে আন্ডারডগও ভাবে নি। আর এখানে, ভারতীয় দলের হয়ে বাজি লড়েছেন সকলেই।
এই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এখনও সিরিজ জিতে ফেরেনি কোনও ভারতীয় দল। প্রথম টেস্ট থেকেই, ভারতীয় দল সেই অসম্ভব কে সম্ভব করার সব ইঙ্গিত দিয়ে শুরু করে দিল। প্রথম টেস্ট জিতে দলের নামের পাশে সিরিজ ফেভারিট ট্যাগ লাগিয়ে নিয়েছে।
Virat Kohli becomes the First Asian Captain and Third World Wide to Win Test Match in Centurion in South Africa. #INDvsSA pic.twitter.com/rf5qEcKpvX
— CricketMAN2 (@man4_cricket) December 30, 2021
কোনও সন্দেহ নেই, এই দক্ষিণ আফ্রিকাকে এখন দুর্বলতম দল মনে হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডে ভিলিয়ার্সের বা ফিল্যান্ডারের মত ঝলকানি নেই এই দলে। এবারের দলে, অধিকাংশ ক্রিকেটার টেস্টে নিজেদের পায়ের তলার জমি শক্ত করতে পারেননি।
আবার এটাও ঠিক যে, সেই জুন মাস থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে হাজারো সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটিও টেস্ট খেলতে পারেনি দলটা।
অন্যদের কথা ভেবে লাভ নেই। আমাদের দলের কথাই বলি। ফেলে আসা তিনটে বছরে, এই ভারতীয় দলটা নিজেদের বদলে ফেলেছে। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে অজিদের হারিয়ে এসেছে। ইংল্যান্ডে গিয়েও হয়েছে সেই একই কীর্তি। আর এবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রোটিয়াদের প্রথম টেস্টেই হারিয়ে সিরিজ শুরু করা কে কী বলা যায়? একটাই শব্দ মনে আসছে : দাদাগিরি ।
একবার এই টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলার কথাটা ভাবুন। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা, ভারতও ব্যাটিং পর্বে, ৫২ রানে ৭ উইকেট তুলে, বুকে জোর ধাক্কা মেরেছিল। সত্যি ব্যাটিং কঠিন উইকেট হয়ে গিয়েছিল। তারপরও ভারতীয় দল, ৩০০’ র বেশি রান তুলে চ্যালেঞ্জটা ঠেলে দিয়েছিল, ডিন এলগারদের দিকে।
ডিন এলগার। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। ম্যাচ শেষে কি বললেন? ‘দলের ব্যাটিং বিপর্যয় আমাদের এই ব্যর্থতার কারণ’। কিন্তু চোখে কি দেখলাম? লড়াইটা হল, বোলারদের। ভারতীয় বোলাররা টেক্কা দিল।
দলের পেসাররা সফল তো দল সফল!
বোলারদের বুল ফাইট:
প্রথম ইনিংসটা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষেই দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা আলগা বল করে গেছে। প্রথমদিন সেটা টের পাওয়া গেছে। সেটা শামি – বুমরা – সিরাজরা মোটেই করেনি। আর এটাই ফেলে আসা চার বছরে, ভারতীয় বোলাররা বিদেশের মাটিতে করে চলেছে। সাফল্যও আসছে।
ম্যাচের শেষে ভারতের সবচেয়ে সফলতম টেস্ট অধিনায়ক কোহলি কি বলেছেন, মনে থাকবে সকলের। ‘ শামি এখন বিশ্বের সেরা তিন পেসারের একজন’। টিভি ভাষ্যকাররা প্রথম টেস্টের সময়, শামি আর ভার্ণন ফিল্যান্ডারের মধ্যে তুলনা করেছিলেন। ফিল্যান্ডারের সাফল্য হোম টেস্টে। আর শামিকে, যখনই বল দিয়ে দেওয়া হয়েছে – তখনই উইকেট নিয়েছেন।
শামির দাপটে প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা বেসামাল হয়ে যায়। ৫ উইকেট যে দাপটে নিয়েছেন, প্রোটিয়াদের দেশে গিয়ে এমন সাফল্য হালফিলের কোনও ভিন দেশের পেসারদের নেই।
শামি টেস্টে ২০০ উইকেট শিকার মিললো প্রোটিয়াদের দেশে।
পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, নেতা কোহলির সময় শামির সাফল্য সবচেয়ে বেশি। শামি ৫৫ টি টেস্ট খেলে ফেললেন। ক্যাপ্টেন ধোনির সময় খেলেছেন ১০টি। তাতে নিয়েছিলেন, ৩৮ টি উইকেট। আর কাপ্তান কোহলির সময় খেলেছেন ৪৫ টি টেস্ট। আর তাতেই ঝুলিতে তুলেছেন: ১৬২ টি উইকেট।
বলাই যায়, নেতা বিরাট ঠিকঠাক ভাবে শামিকে ব্যবহার করে চলেছেন। তিনি মুখে বললেন বটে সেরা তিনে শামি একজন। কিন্তু মুখে সেদিন না বললেও, বিরাট জানেন সেরা দুয়ের মধ্যে আছেন – বুমরা।
বুম বম বামরার আবার এই টেস্টে হয়ে গেল বিদেশের মাটিতে ১০০ উইকেটের সেঞ্চুরি! ভারতের সেরা টেস্ট একাদশে সাজাতে গেলে বুমরাকে রাখতেই হবে।
কোনও সন্দেহ নেই, সেঞ্চুরিয়ান টেস্ট বুমরাকে চিনিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কামিন্স আর তিনি – টেস্টে এক অন্য জাতের বোলার। হতে পারে রাবাডা ৩টি উইকেট বেশি পেয়েছেন বুমরার থেকে। একটা দিন হয়তো সমান সমান টক্কর দিয়েছেন। কিন্তু ধারাবাহকতায়? বুমরা ইজ দ্য বেস্ট।
Siraj and Mayank Celebration ?♥️#INDvsSA • @bcci pic.twitter.com/xQ8wJUfpWi
— Troll RCB Haters (@Troll_RCBHaters) December 30, 2021
সিরাজ। ১১ টি টেস্ট খেলা বোলার। বিপক্ষ দল যাঁকে টার্গেট করে রাখে রান তোলার জন্য।
কিন্তু শেষ টেস্টে যে ৩টি উইকেট নিয়েছেন ( আরও পেতে পারতেন) প্রতিটি সোনার সমান। এখন দক্ষতা আর যোগ্যতা দিতে সিরাজ দলের সেরা তৃতীয় পেসার।
প্রথম টেস্টে ম্যাচের সেরা রাহুল, রোহিত নেই – ওয়ান ডে সিরিজে তিনি নেতা।
ব্যাকফুটে ব্যাটিং:
এই সিরিজে ভারত কেবলমাত্র দাপটে জয়ের সুযোগ খোয়াতে পারে এই ব্যাটিংয়ের জন্য। কে এল রাহুলের প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং ছাড়া আর কারোর উপর ভরসা করা যাচ্ছে না। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের চেয়ে এগিয়ে ভারতীয় ব্যাটিং – এটা বুক ঠুকে বলা যাচ্ছে না।
ময়াঙ্ক আগরওয়াল পাস মার্ক পাননি। এই টেস্টে ১৩৭ টি বল সামলেছেন, কিন্তু অনেক ভুলভাল শর্টস খেলেছেন। জমাট লাগছেনা। রাহানেকে যতটুকু দেখা গেছে, ফর্মে আসার সম্ভাবনার সলতে জ্বলছে।
Congratulations team India ?? on a brilliant win in Centurion against South Africa ?? at end of the year 2021. #INDvsSA pic.twitter.com/Cyz86ohA9s
— Sonia Gandhi (@SoniaGandhi_FC) December 30, 2021
যা খবর আপডেট মিলছে, তাতে জানা গেছে – দুয়ান্নে অলিভিয়ার দ্বিতীয় টেস্টে দলে ফিরছেন। তাতে, ব্যাটিং সহজ হবে না বলে মনে হয়। চিন্তা একটাই, নুতন বছর – লিডস বা অ্যাডিলেড টেস্ট ঘটে গেলে চাপ হয়তো বাড়বে। জোহানেসবার্গের দ্বিতীয় টেস্ট ভারতীয় দলকে নিয়ে হতাশ না হওয়া উচিত। কারণ, এই দল পারে পাল্টা জবাব দিতে। বারবার ফিরে আসতে। তাই তো টেস্ট ইতিহাসে এই দলের ধ্বজা উড়ছে এখন পতপত করে।
ছবি: সৌ টুইটার।