এখনও কাশ ফোটেনি।
তো কী?
এখনও মেঘের গায়ে নীলের ছোপ লাগেনি।
তো কী?
এখনও পুজো সংখ্যায় শীর্ষেন্দুর গল্পটা সবার আগে পড়া হয়ে ওঠেনি।
তাতেই বা কী?
রবিবার ভোরে মহালয়া। চারটে নয়, ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কাল স্প্যানিশ ভাষায় চণ্ডীপাঠ করবেন। রূপং দেহি, জয়ং দেহি…।
বহুদিন পরে আমরা জেগে উঠেছি। এতদিন আমরা ইউরো কাপের খেলা দেখছিলাম বটে, কিন্তু মন উঠছিল না। বর্ষা আছে, ভরা নদী আছে, ফুটবল আছে কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নেই। এ হয় নাকি? যেন বর্ষা আছে, কিন্তু ইলিশ নেই। যেন ইলিশ আছে, কিন্তু ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক নেই। কানু বিনে গীত নেই এবং ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ছাড়া ফুটবলও নেই।
আজ আমরা ফুটবল পেয়েছি। কাল আমরা ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠব। ভোরে খেলা দেখব, আবার রাত জেগে খেলা দেখব। দিবসরজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি? কার আবার? ফুটবলের।
আজ রাত্তিরটা ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়। হুতোম ‘কলিকাতার চড়ক পার্ব্বণ’-এ লিখেছিলেন, ”আজ নীলের রাত্তির। তাতে আবার শনিবার। শনিবারের রাত্তিরে সহর বড় গুলজার থাকে। পানের খিলীর দোকানে বেল লন্ঠন আর দেওয়াল গীরি জ্বলচে। ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে বেলফুলের গন্ধ ভুর ভুর করে বেরিয়ে যেন শহর মাতিয়ে তুলছে…আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়।”
কার সাধ্যি নিদ্রা যায়? কাল ভোরে অকাল মহালয়া। বীরেনবাবু আসবেন দুই অবতারে। মেসি ও নেইমার। আমরা গরম চা নিয়ে ফুটবলের চণ্ডীপাঠ শুনব। খেলার শেষে পাঁঠার মাংসের দোকানে লাইন দেব। ফুটবল আমাদের বড় নেওটা। আজ ফুটবলের গায়ে কাদার গন্ধ শোঁকার দিন, আজ ফুটবলের গায়ে শিউলির গন্ধ শোঁকার দিন। আহা ফুটবল, তুমি যেন ছোটবেলার বেকারি বিস্কুট। তোমার সংকট আছে। কিন্তু বিনাশ নেই।
সেই কবে থেকে পাড়ার ফুটবলকে আমরা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় ভাগ করে ফেলেছি। এ পাড়ার মন্টু যদি পেলে, তো ও-পাড়ার পিন্টু মারাদোনা। এ গাঁয়ের নবীন যদি হয় গ্যারিঞ্চা, তো ওই গাঁয়ের রহমান ডি স্টেফানো। ক্লাস এইটের পটলার গায়ে মেসির জার্সি তো ক্লাস নাইনের ভুতোর গায়ে নেইমারের জামা। বাবুদের বুলবুলি বা পায়রার লড়াইয়ের মতো ফুটবলের লড়াই নিয়েও কম আকচাআকচি ছিল না। ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটি যেন বাংলার ফুটবলের মহাকাব্য। সেখানে দুই ভিন মুলুকের দুই কর্তার প্রেস্টিজ ফাইট ছিল। সেই ফাইটের ফাঁক গলে কখন ঢুকে পড়েছিল এক আশ্চর্য প্রেমের পাঁচালি। ছবিটির পর্দা জুড়ে ভুরভুর করছে আবহমান বাংলা। সেখানে খেলতে গিয়ে চোট পাওয়া নায়ক বগার জন্য চুনহলুদ গরম করছে নায়িকা মনসা। গাছের মাথায় উঠে চোঙা নিয়ে রিলে করছে সুখেন দাস। আর আছে তোতলা ভটচাজ। যিনি একাধারে পুরুতমশাই এবং রেফারি। আম-জাম-নিম-জারুলে ছাওয়া বাংলার ওয়াটারলুর প্রান্তরে যিনি বাঁশি হাতে রেফারির ভূমিকায় নেমেছেন। এবং নিজের হাতে বল লাগিয়ে নিজেই হ্যান্ডবলের বাঁশি বাজাচ্ছেন। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দুই দলের কর্তা—উত্তমকুমার ও জহর রায়। যেন একজন ব্রাজিলের কোচ, আর একজন আর্জেন্টিনার কোচ। তাঁদের গায়ে কোট-প্যান্ট নেই। আছে ধুতি আর পাঞ্জাবি। উনিশ শতকের বাবুদের মতোই উত্তমকুমারের দারুণ গুমোর। দল পেনাল্টি পেয়েছে। আর তিনি বাইরে থেকে বলছেন, ‘এই বগা, বাইরে বল মার। আমরা পেনাল্টিতে জিতি না।’
জুলাই যেমন ফুটবলের মাস, জুলাই তেমন উত্তমকুমারেরও মাস। বড় বাংলা-বাংলা গন্ধ চৌদিকে। মেঘের গায়ে, ঘাসের ডগায় অথবা ময়নাপাড়ার মাঠে যেন শুধু বাঙালিই ঘুরঘুর করছে। আর বাঙালি মানে ফুটবল। ফুটবল মানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা।
কাল মহালয়া। বীরেনবাবু নিজেই অস্ত্র দেবেন দুজনের হাতে। একজন হলেন সিঙ্গিবাগানের মেসি, অন্যজন জেলেপাড়ার নেইমার।
হুতোম থাকলে কত নকশাই যে লেখা হতো!