আরেকটা ইউরো চলে গেল। তিপ্পান্ন বছর পর চ্যাম্পিয়ন হল ইতালি। আর এই প্রথম ইউরোর ফাইনালে উঠেও চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটা ছুঁতে পারল না ইংল্যান্ড। প্রথম বার ফাইনালে উঠৈই চ্যাম্পিয়ন হলে একটা ইতিহাস তৈরি হত। কিন্তু সেটা তো হল না। বরং যে ইতালি গত বারের বিশ্ব কাপে কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি তারাই তিন বছরের মধ্যে সাফল্যের রাজপথে পৌছে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। তবে সেমিফাইনালের মতো তাদের ফাইনালেও জিততে হল টাই ব্রেকারে। ইতালির জয়ের নায়ক তাদের গোলকিপার জিয়ানলুইগি দোনারুমা। ১-১ গোলে ফাইনালের নির্দ্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময় উতরে যাওয়ার পর টাইব্রেকারে দোনারুমা দুটো পেনাল্টি বাঁচান। টাই ব্রেকারে এক সময় ইতালি ১-২ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল। তখন নার্ভ ঠিক রেখে দোনারুমা পর পর দুটো শট বাঁচান। তার আগে মার্কাস র্যাশফোর্ডের শট বাইরে যায়। এর পর জর্ডন স্যাঞ্চো এবং বুকায়া সাকার শট বাঁচান দোনারুমা। সেমিফাইনালেও তিনি টাই ব্রেকারে জিতিয়েছিলেন স্পেনের বিরুদ্ধে। আর গোটা টুর্নামেন্টে টানা সাতটি ম্যাচ জেতার পিছনেও এসি মিলানের এই গোলকিপারটির অবদান কম নয়। সব মিলিয়ে বিচারকরা তাঁকে টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করেছেন। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ইউরোর সেরা হয়ে গোল্ডেন বল পেয়েছেন দোনারুমা।
গোল্ডেন বুট পেয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। চার ম্যাচে পাঁচ গোল করে তিনি পেয়েছেন সোনার বুট। চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক সিকও পাঁচটি গোল করেছেন। কিন্তু বিচারকরা দেখেছেন রোনাল্ডোর একটা অ্যাসিস্ট আছে, যেটা সিকের নেই। তিনি পেয়েছেন রুপোর বুট। আর ব্রোঞ্জ বুট পেয়েছেন করিম বেঞ্জামা (৪ গোল)। ইংল্যান্ডের গোলকিপার জর্ডন পিকফোর্ড সেরা গোলকিপার হয়ে পেয়েছেন গোল্ডেন গ্লাভস। ইংল্যান্ডকে ফাইনালে তুলে এবং টাই ব্রেকারে দুটো সেভ করেও পিকফোর্ড টিমকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি। কিন্তু প্রথম পাঁচটা ম্যাচে একটা গোল না খেয়ে এবং গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র দুটো গোল খেয়ে তিনি এবার সবার নজর কেড়েছেন। সেরা গোলকিপার হওয়া তারই পুরস্কার।
কিন্তু বিশ্বের সাধারণ দর্শকরা কী পেল? একটা নতুন সিস্টেম, একটা মনে রাখার মতো গোল, একটা বলার মতো মুভমেন্ট কি উপহার দিয়েছে এই টুর্নামেন্ট? ইতালির অ্যাটাকিং ফুটবল চোখ টেনেছে প্রথম ম্যাচ থেকেই। পাস, পাস আর পাস। ফাইনালেও তারা ৮৩০টা পাস খেলেছে। কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই তিকিতাকা নয়। করাণ তিকিতাকার সৌন্দর্য আরও বেশি ছিল। তবে ইতালি তাদের ডিফেন্সিভ ফুটবলের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। দেখতে ভাল লেগেছে সেটা। তবে সেটা তাদের দেশের পক্ষে নতুন হলেও ফুটবল দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। ইতালি খেলেওছে ৪-৩-৩ ছকে। সেটাও অনেক পুরনো। আর তাদের অ্যাটাকিং ফুটবল কিন্তু শেষ দুটো ম্যাচে জেতাতে পারেনি। তাদের অ্যাটাকিং ফুটবল কিন্তু নতুন কোনও তারকার জন্ম দেয়নি। তাদের ফরোয়ার্ড অর্থাৎ চিরো ইম্মোবাইল কিংবা লরেঞ্জো ইনসিগ্নের নাম ঘরে ঘরে পৌছে যায়নি। ২০০৬ সালে ইতালি যখন শেষ বার বিশ্ব কাপ জিতেছিল, তখনও তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল টাই ব্রেকারে। তখনও কিন্তু তারা প্রচুর গোল করেনি। তবু তাদের ফ্রান্সিসকো তোত্তি কিংবা লুকা তোনির নাম বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছিল। দেল পিয়েরোর বিশ্ব তারকা হওয়া তো সেই টুর্নামেন্ট থেকেই।
আসলে এবার ইউরোপের বড় টিমগুলো বিদায় নিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি। ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডস দ্বিতীয় রাউন্ডের গণ্ডি টপকাতে পারেনি। এরা প্রত্যেকেই প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন। প্রচুর তারকা ফুটবলার আছে এই চার টিমে। তারা শুরুতেই বিদায় নেওয়ায় টুর্নামেন্টের জাঁকজমক কমতে থাকে অনেক আগেই। বেলজিয়াম চলে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। স্পেন ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালে ইউক্রেন এবং সেমিফাইনালে ডেনমার্কের মতো সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছে। সেটা তাদের সুবিধে হয়েছে। তার জন্য তাদের দায়ী করা যায় না। কিন্তু টুর্নামেন্টের আকর্ষণ তাতে অনেক কমে গেছে। তবে তারা ক্রোয়েশিয়া এবং জার্মানির মতো দলকে হারিয়েছে। এটা কম কৃতিত্বের নয়। তবে কোনও ম্যাচই মনে রাখার মতো হয়নি। কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে। ব্যস। তার বেশি কিছু নয়।
একান্নটা ম্যাচে একটা মনে রাখার মতো গোল আছে। তা হল স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেক প্রজাতন্ত্রের প্যাট্রিক সিকের পঞ্চাশ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে গোল করা। একান্নটা ম্যাচে মাত্র একটা গোল। তার মানে টুর্নামেন্টের সাদামাটা ব্যাপারটা কতটা প্রকট। নতুন কোনও সিস্টেমও তো দেখা গেল না। ইংল্যান্ডের ৪-২-৩-১ ছক তাদের ফাইনালে তুলেছে। কিন্তু সেই ছকের মধ্যে কোনও দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার নেই। উপযোগী নিশ্চয়ই, কিন্তু তার রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ যে দর্শকদের মোহিত করেছে তা কিন্তু নয়। আর এই ছক কোনও নতুন নায়কের সন্ধান দেয়নি। মনে রাখার মতো গোল কিংবা মুভমেন্ট নেই। তবে হ্যাঁ, প্রশংসা করতে হবে তাদের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের। তাঁর কোচিংয়েই ইংল্যান্ড রাশিয়াতে সেমিফাইনালে উঠেছিল। এবার ফাইনালে। ধারাবাহিকতা আছে বলতে হবে। আর ষোল মাস পরে কাতার বিশ্ব কাপ। সাউথগেটই মনে হয় কোচ থাকবেন। তাঁর টিমেও সব বাচ্চা ছেলে। বুকায়া সাকার বয়স মাত্র ১৯। গর্ডন স্যাঞ্চোর ২১। মার্কাস র্যাশফোর্ড, রহিম স্টার্লিং, ডেকলান রিসে, কলভিন ফিলিপসদের বয়স কম। আগামি দিনে তারা আরও ফুটে উঠবেন। হ্যারি কেন চারটে গোল করলেও দুর্দান্ত কিছু খেলেছেন বলা যাবে না। রহিম স্টার্লিং শুরুটা ভাল করেছিলেন। শেষটা ভাল হল না। ইংল্যান্ড ফাইনালে উঠলেও তাদের স্ট্র্যাটেজি যে অন্য দেশগুলো অনুসরণ করবে তা বলা যাচ্ছে না।
না আছে নতুন সিস্টেম, না নতুন তারকা। না বলার মতো মুভমেন্ট। ইতালি অ্যাটাকিং ফুটবল খেলল, পাসের বন্যা বওয়াল। কিন্তু গোল কোথায়? নতুন তারকাও নেই। পাওলো রোসি তো দূরের কথা, একটা দেল পিয়েরোও নেই। ইতালি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাদের ডিফেন্স এবং গোলকিপারের জন্য। দোনারুমা এই মুহূর্তে জাতীয় নায়ক। কিন্তু দিনো জফ তো দূরের কথা, জিয়ানলুইগি বুফোঁ হতেও তাঁকে এখন অনেক পথ পেরোতে হবে। তাঁর বয়স মাত্র ২২। নবীন গোলকিপার প্রতিশ্রুতি জুগিয়েছেন। যেতে হবে অনেক দূর। প্রশংসা করতে হবে রবের্তো মানচিনিরও। একটা নুয়ে পড়া টিমকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তুলে তিনি মহাদেশসেরা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে ইতালিবাসীর প্রত্যাশা বেড়ে গেল। এবার তারা আবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের স্বপ্ন দেখতে পারবে।
কিন্তু সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের জন্য তেমন কিছুই দিয়ে গেল না এবারের ইউরো। এই টুর্নামেন্টকে ভুলতে বেশি সময় লাগবে না।