বনগাঁ: ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। সময় বলা যায় রাতের দ্বিপ্রহর। কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে তখন ভিড় নিমন্ত্রিতদের। প্রায় ৮০০ জনকে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। রাস্তায় পুলিসের পাহারা চলছে। এমন সময় পালকি চেপে বিয়ে করতে এলেন গোবরডাঙার বাসিন্দা মুর্শিদাবাদের জজ পণ্ডিত শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী কালীমতি।
বর্ধমানের পলাশডাঙার প্রয়াত ব্রহ্মানন্দ মুখ্যোপাধ্যায়ের ১০ বছরের বিধবা মেয়ে। কালীমতির প্রথম বিয়ে হয়েছিল ৪ বছর বয়সে। আর বিধবা হন ৬ বছর বয়সে। কালীপ্রসন্ন সিংহ, রমাপ্রসাদ রায়, নীলকমল মুখ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষ সহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়ে থেকে কনের মা লক্ষ্মীদেবীকে দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করালেন। সেই সঙ্গে এই দিনটি ঘিরে তৈরি হল এক ইতিহাস।
শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গ
বিধবা বিবাহ আইন পাশের পর বিদ্যাসাগর বিস্তর খরচ করে প্রথম বিধবা বিবাহের জমকালো এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল প্রথম বিধবা বিবাহের দিনটি। সেই দিনের বিধবা বিবাহ নিয়ে পরবর্তীতে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। একইসঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোবরডাঙার খাঁটুরার বাসিন্দা শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রথম বিধবা বিবাহ করে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন সমাজে।
এমন কাজের পর তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দেয় ব্রিটিশ সরকার। বনগাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে গোবরডাঙা পুরসভা স্থাপিত হলে প্রথম পুরপিতা হন। বিধবা বিবাহ করার পর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল বলে জানালেন গোবরডাঙার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পবিত্র মুখ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, শ্রীশচন্দ্রকে গোবরডাঙায় তাঁর পৈতৃক ভিটেতে আসতে বারণ করে তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায়শ্চিত্ত করে তাঁকে আসতে হয় পৈতৃক ভিটেতে।
প্রথম পুরপিতা হয়ে তিনি গোবরডাঙার উন্নয়নে এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন। রেললাইন স্থাপন সহ রাস্তাঘাট সংস্কার করে গোবরডাঙার ভোল পাল্টে দেন।
অথচ শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের স্মৃতি আজ আর সেভাবে দেখা যায় না। তাঁর বসতভিটে আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। তবে ১৮৬৮ সালে তাঁর মায়ের নামে কঙ্কনা বাওড়ের ধারে গড়ে তোলা জোড়া শিবমন্দিরের অস্তিত্বটুকু বর্তমান রয়েছে। তাঁর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পুরসভার পক্ষ থেকে খাঁটুরায় তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন সরণি। পুরসভায় খোদাই করা রয়েছে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভবন নামটি। গোবরডাঙার পুরপ্রধান শঙ্কর দত্ত জানান, তাঁর স্মৃতিতে বেশ কিছু রাস্তার নামকরণ সহ মূর্তি স্থাপন করা হবে।