পাক্কা এক বছর অপেক্ষা করার পর অবশেষে উদ্বোধন হল টোকিও অলিম্পিকের। তবে কোভিড আবহে শুরু হওয়া এবারের অলিম্পিকের উদ্বোধনে দেখা গেল না সেই জৌলুস যা সাম্প্রতিককালের উদ্বোধনগুলিতে দেখা গেছে। মানুষ, যন্ত্র, টেকনোলজির মিশ্রনে গড়া সেই সব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানগুলিতে ছিল নানারকম উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়। কিন্তু শুক্রবার টোকিও সে সবের ধারেকাছ দিয়ে হাঁটেনি। অন্যবার যেমন নাচ, গান, অভিনয় দিয়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করা হয়, এবার সে রকম কিছু ছিল না। আর দর্শকই তো নেই আটষট্টি হাজারের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। সব মিলিয়ে গ্যালারিতে হাজার খানেক মানুষের জমায়েত ছিল। তবে মাঠের মধ্যে ২০৫টি দেশের হাজার তিনেক অ্যাথলিটের মার্চ পাস্টেই মন ভরে গেছে টিভি দর্শকের।
তবে একেবারে কিছু ছিল না তা বলা যাবে না। সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানে জাপানের ট্রাডিশনাল ড্রাগন প্রদর্শনী কিংবা রূপকথার কয়েকটি ঝলক দেখা গেল স্থানীয় শিল্পীদের উপস্থাপনায়। জাপানিদের শৃঙ্খলাবোধ বরাবরই অন্যদের ঈর্ষার কারণ। এদিন তারা খুব বেশি তাদের নাচগান দেখাবার সুযোগ পায়নি। তবে যেটুকু পেরেছে তার মধ্যে মিশে ছিল ইতিহাসের সঙ্গে আধুনিকতা। এবং সেই সংমিশ্রন এত আন্তরিক যে মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।
বরাবরই উদ্বোধনী সন্ধ্যার সেরা আকর্ষণ হয় অ্যাথলিটদের মার্চ পাস্ট। এবারও সেটাই হল। তার আগে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে যে সব মানুষ মারা গেছেন এবং মিউনিখ অলিম্পিকের সময় প্যালেস্টাইনিরা যে হত্যালীলা চালিয়েছিল সেই সব অ্যাথলিটদের স্মৃতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অলিম্পিক সম্মান পুরস্কার পান বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস। মার্চ পাস্টের শুরু হয় গ্রিসের প্রতিযোগীদের দিয়ে। সে দেশেই যে অলিম্পিকের সূচনা ১৯৯৬ সালে। গ্রিসের পরেই আসে অলিম্পিক রিফিউজি টিম। বিভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এই টিম। একে একে দেশগুলি তাদের দেশের নিজস্ব পোশাক পরে মাঠের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। তাদেরকে সাজানো হয়েছিল জাপানি বর্ণমালায়। সেই বিচারে ভারত ছিল একুশ নম্বরে। ভারতের হয়ে জাতীয় পতাকা বহন করেন হকি টিমের অধিনায়ক মনপ্রীত সিং এবং লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী মেরি কম। করোনার জন্য খুবই ছোট প্রতিনিধি দল ছিল ভারতের। কুড়ি জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে মাত্র ছয় জন কর্মকর্তা। দুশো জনের দল নিয়ে আসে আমেরিকা। সবার শেষে ছিল জাপান। তারা অবশ্য সবচেয়ে বড় দল নিয়ে এসেছিল। জাপানের আগে ছিল ফ্রান্স। কারণ তারাই আগামিবারের অলিম্পিকের আয়োজনকারী দেশ। উদ্বোধনের বর্ণাঢ্যহীনতা অনেকটাই কমিয়ে দেয় মার্চ পাস্টের অংশগ্রহনকারীদের স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা। লক্ষ্যণীয় ছিল আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের পোশাক। দেশজ স্টাইলে তারা শুধু পরিধানই পরেনি দেশজ নাচ-গানে জমিয়ে দেয় উদ্বোধনের আসর। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই আসরের জৌলুস কিন্তু তখন অনেকটাই বেড়ে যায়।
জাপানের সম্রাট নারুহিতো অলিম্পিকের উদ্বোধন করেন। ১৯৬৪ সালে যেবার টোকিওতে অলিম্পিক হয়েছিল, তখন তাঁর পিতামহ উদ্বোধন করেছিলেন। প্রতিযোগীদের হয়ে শপথবাক্য পাঠ করার পর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ তাঁর ভাষণে অলিম্পিকের আদর্শের কথা তুলে ধরে আগামি পনেরো দিন সেই আদর্শ বজায় রাখার কথা বলেন। আর এ সবের মধ্যেই দিনের সেরা মুহূর্ত ছিল তারায় ভরা আকাশে ড্রোনের মাধ্যমে একটি বিশালাকায় গ্লোবের আবির্ভাব। দেখা গেল পাঁচটি মহাদেশের অবয়ব ফুটে উঠেছে তাতে। অলিম্পিকের পঞ্চবলণ তো ওই পাঁচ মহাদেশের প্রতিনিধিত্বের কথাই বলে। আর ্এর সঙ্গে বলতেই হবে মাঝে মাঝেই অন্ধকার আকাশের বুক চিরে নয়নাভিরাম আতসবাজির প্রদর্শনী। ইলেক্সট্রনিক্সের দেশ সুযোগ পায়নি টেকনোলজির খেলা দেখানোর। কিন্তু অন্তরের ভালবাসা দিয়ে গড়া তাদের এই উপহার সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ভাল লাগতে বাধ্য।