কলকাতা: এত দিনে সার সত্যটা বুঝেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মেদিনীপুরে সাংগঠনিক বৈঠকে তিনি বলেছেন, দল এখনও সরকার গড়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেনি। তৃণমূলের থেকে আমাদের এখনও অনেক শেখার আছে। দিন কয়েক আগে প্রায় একই ধরনের কথা শোনা গিয়েছিল বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের গলায়। সোমবার সুকান্ত যেটা বলেননি, সেটা হল, রাজ্যের বিজেপি আগামী দশ বিশ সালের মধ্যেও বাংলার ক্ষমতা দখল করতে পারবে না। তার আগে রাজ্য থেকে দলটা উঠেও যেতে পারে। কিংবা দলটা তৃণমূলের সঙ্গে মিশেও যেতে পারে। সে সব অবশ্য ভবিষ্যতের কথা।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ১৮ টি আসন পাওয়ার পর বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতারা এমন লাফঝাঁপ শুরু করে দিয়েছিলেন যে মনে হচ্ছিল, তাঁরা রাজ্যে প্রায় ক্ষমতায় এসেই গিয়েছেন। তার পর থেকেই বিজেপি নেতারা বলতে শুরু করে দিলেন, উনিশে হাফ, একুশে সাফ। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে আমরা দেখলাম, তৃনমূল কেমন সাফ হয়েছে। তারা ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের থেকেও বেশি আসন পেল। আর বিজেপি দুশো তো দূরের কথা। একশোর অনেক আগে থেমে গেল।
অথচ বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি নেতাদের সে কী হম্বিতম্বি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বুক বাজিয়ে বলতে লাগলেন, অব কি বার দুশো পার। কারা তাঁকে এই দুশো পারের বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন, বড্ড জানতে ইচ্ছা করে। বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি প্রায় কেন্দ্রের গোটা মন্ত্রিসভাকে এনে হাজির করেছিল বাংলায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লি-বাংলা ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করলেন। বাংলার নেতাদের উপর ভরসা না রেখে দিল্লির নেতারা ভোটের ব্যাপারে ছড়ি ঘোরাতে লাগলেন। কৈলাস বিজয়বর্গীয়, অরবিন্দ মেনন, শিবপ্রকাশের মতো কেন্দ্রীয় নেতারা ক্যাম্প করে বসলেন বাংলায়, যে বাংলার সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগাযোগ নেই।
তৃণমূল খুব সাফল্যের সঙ্গে এই দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের নেতাদের বাংলায় আসার বিষয়টিকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে ফল পেল। বাংলার মানুষ বহিরাগত তত্ত্বকে মেনে নিল। ভোটে তার ফল মিলল। সঙ্গে ছিল বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণ। এই হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ যে বাংলায় খায় না, এটাই বুঝতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা। বাংলার তেমন কোনও দাপুটে নেতাকে দেখা গেল না, যিনি বুক বাজিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বলবেন যে, মেরুকরণ বাংলার মানুষ মেনে নেবে না। ফল যা হওয়ার তাই হল।তার উপরে কৈলাস বিজয়বর্গিয়রা সমানে তৃণমূল ভাঙিয়ে নেতা, মন্ত্রীদের বিজেপিতে নিয়ে নিতে থাকলেন। সে কী ব্যস্ততা, তৎপরতা। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মন্ত্রীকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ানোর জন্য চার্টার্ড ফ্লাইট পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেই ফ্লাইটে চেপে রাজীবরা দিল্লি গিয়ে অমিত শাহের হাত থেকে বিজেপির পতাকা নিয়ে তাতেই রাতে কলকাতায় ফিরলেন। কৈলাস বলে বেড়াতে লাগলেন, তৃণমূলের একশোরও বেশি বিধায়ক দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন। কিন্তু কোথায় কী? ভোটে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ার পর সেই যে কৈলাস, অরবিন্দরা বাংলা ছেড়েছেন, আজ পর্যন্ত তাঁদের আর টিকিটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
তার মধ্যেই ফল প্রকাশ হতে না হতেই রাজ্য বিজেপিতে শুরু হল গৃহযুদ্ধ। যে যাঁকে পারছেন,ল্যাং মারছেন। মিডিয়ার সামনে, সামাজিক মাধ্যমে চলল আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রাজ্য বিজেপিতে।
বলা হয়, বিজেপি নাকি রেজিমেন্টেড পার্টি। সেই রেজিমেন্টেড পার্টির একী হাল? আসলে দলটার তো বুথভিত্তিক কোনও সংগঠনই নেই। বুথে বুথে সংগঠন না থাকলে ভোটে জেতা কি এত সহজ? একটা সময় রাজ্যে সিপিএমের বুথ ভিত্তিক সংগঠন জোরদার ছিল বলেই তারা বছরের পর ভোটে জিতে এসেছে। পালা বদলের পর সিপিএমের সেই সংগঠন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। বাম জমানায় তা নিয়ে বিরোধীরা নাকি কান্না কাঁদত। আর অনিল বিশ্বাসরা বলতেন, আমরা তো আর বুথে তৃণমূলের হয়ে লোক বসিয়ে দেব না। ঠিক একই কথা এখন বলে তৃণমূল। শাসকদলের নেতাদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, আমরা তো বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএমের জন্য বুথে লোক বসাতে যাব না।
কথা হচ্ছে, সংগঠন মজবুত না থাকলে শুধু ওরা মারছে বলে মরা কান্না কেঁদে লাভ নেই। শুধু শাসকদল সন্ত্রাস চালাচ্ছে বলে কেঁদে মরলেও লাভ নেই। আজ পর্যন্ত বিজেপি সেই বুথভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি। সংগঠন গড়বে কী, নিজেদের মধ্যে মারামারি করতেই তো সময় কেটে যাচ্ছে।
এই সব কথাই মেদিনীপুরে সোমবার অকপটে বলে ফেলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। যে সমস্ত সাধারণ কর্মী মাঠে ময়দানে শাসকদলের হাতে মার খেয়ে দলটা করেন, সুকান্তের এই সব কথা তাঁদেরও মনের কথা। শুধু নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে এই দল তৃণমূলকে হটাবে? এ তো দিবাস্বপ্ন। সেই স্বপ্নেই আঘাত করেছেন সুকান্ত। বড় সত্যিটা বলে ফেলেছেন। এখন দেখা যাক, তাঁর এই মন্তব্য রাজ্য বিজেপিকে ঝাঁকুনি দিতে পারে কি না।