আজ বাঙালি বড়ো কাঁদছে। বাঙালির প্রেম, অনুরাগ, পূর্বরাগ, বিরহের সুরগুলোই যে নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো আজ। বাঙালির গলার স্বর বুজে আসছে আজ। কি মিষ্টি এক সকাল থেকে শুরু করে শঙ্খ বাজিয়ে লক্ষী ঠাকুরকে ঘরে তোলা অবধি, প্রথম প্রেমের শিশিরস্পর্শ থেকে বাসরঘরের অপাঙ্গ চাহনি অবধি বাঙালির মনের মনিকোঠা যে দোয়েল পাখি সুরের ঝর্ণায় ধুইয়ে দিতো ,সেই কন্ঠটাই যে আজ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই পথ এতদিন বাদে বুঝি সত্যিই শেষ হলো, কাউকে কিছু না বলতে দিয়েই।
বাঙালির কানে কানে আর কেউ কোনোদিন বলবে না এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার। গানে গানে ইন্দ্রধনু আঁকা আর হবে না।
সূর্য ডোবার পালা আচম্বিতেই এলো আমাদের সামনে ব্যাথার ডালি নিয়ে। বিশ্ব বরেণ্য শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। রেখে গেলেন তার অবিনশ্বর সব গানের ডালি যা বাঙালির চিরকালের সম্পদ। বাঙালির রোমান্স,বাঙালির নস্টালজিয়া. বাঙালির সবকিছু।
জন্ম কলকাতার ঢাকুরিয়াতে, ১৯৩১ সালে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সন্ধ্যা ছিলেন সকলের ছোট, সকলের আদরের। বাবা ছিলেন রেল এর কর্মী। ছোট থেকেই সুরের প্রতি ছিল এক অদ্ভুত ঝোক। সুর যেন খেলে যেত তার গলায়। কঠিন কঠিন রাগপ্রধান গানকে অনায়াসে বশ করে ফেলার জাদুকাঠি ছিল এই বাচ্চা মেয়েটির কাছে । পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, এ টি কানন এবং চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে কঠিন সাধনার পর তিনি পৌঁছলেন তার গুরুর কাছে। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান সাহেবের কাছে। প্রতিভা এবং শেখার ইচ্ছে দেখে উস্তাদ সন্তানের ভালোবাসায় তৈরী করলেন ভারতবর্ষের এক কিংবদন্তিকে যার গলার আওয়াজ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে গোটা বাঙালিকে পরবর্তী ৭০ বছর। ক্লাসিকাল মিউজিকে পারদর্শিতার সেই অল্প বয়সেই।
তারপর এক সময় ডাক এলো আরবসাগর তীর থেকে। বলিউড এ প্লেব্যাকের সুযোগ এলো তার সামনে। কিন্তু ভালো লাগলো না সেখানের . কাজ করার রীতিনীতি। ঘরের মেয়ে ফিরে এলেন ঘরে, কলকাতায়। বাংলাতেই গান গাইতে চান তিনি। আসলে দেবী সরস্বতী যে তার ভবিতব্য অন্য ভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন। ক্লাসিকাল এ পারদর্শী হয়েও বেছে নিলেন প্লেব্যাক এর দুনিয়া। পরবর্তীকালে এই দুই দুনিয়াকেই একই ভাবে সুরের মায়াজালে, গানের ইন্দ্রধনুতে মাতিয়ে রেখে গিয়েছেন তিনি। প্লেব্যাকে জুটি বেঁধেছেন হেমন্ত, মান্না, শ্যামল মিত্র দের দের সঙ্গে। সৃজন করেছেন অমর, কালজয়ী বাংলা গানের সম্ভার। স্বর্ণযুগের প্রতিটি গান হীরকদ্যুতি ছড়িয়েছে তার গলার আওয়াজে। পুরস্কারে ভরে উঠেছে বৈঠকখানার কেবিনেট। কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর পুরস্কারে কিছু যায় আসে? পুরস্কার তাকে মাপতে পারে কখনো, কোনোদিন? আসলে সন্ধ্যার গলার মাদকতায়, পেলব ছোঁয়ায় বাঙালির ঘুম ভাঙে, বাঙালির প্রেম আসে, প্রেম যায়, বিরহে স্নান করে বাঙালি, রাতের গভীর অন্ধকারে প্রেয়সীর বুকে মাথা রেখে চরম ভালোবাসার মুহূর্তে বাঙালির কানে খেলা করে যায় সন্ধ্যার সুর, সন্ধ্যার গানের কলি। বলা হয় সুচিত্রা সেন মহানায়িকা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলে একজন গায়িকা সেই সময়ে জন্মেছিলেন বলে। শুধু সুচিত্রায় বা কেন? সুপ্রিয়া দেবী থেকে শুরু করে সেই সময়ের যেকোনো নায়িকা সন্ধ্যার একটা গান পেলে বর্তে যেতেন। সুরকার, গীতিকার রা দ্বিগুন উৎসাহে সৃজনশীলতায় মগ্ন হতেন সন্ধ্যা গাইবেন বলে। এই সেদিন ও সাইন্স সিটি তে মান্না দে র সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় স্টেজে উঠবেন শুনে প্রথম দুটো রো শুধু রেখে দিতে হয়েছিল এই প্রজন্মের গায়ক গায়িকাদের জন্য। তারা যে একটু কাছ থেকে দেবী দর্শন করতে চান। অনুষ্ঠান শুরু হতে দর্শকরা শুধু অঝোর ধারায় কাঁদছেন। গান শোনা পরে হবে। পছন্দের গানের অনুরোধ পরে হবে। সামনে যে ইতিহাস প্রতক্ষ্য করছেন তারা। বাঙালির সঙ্গীত ইতিহাসের দুই তানসেন কে চোখের সামনে দেখছেন তারা। ইতিহাসকে স্পর্শ করার সুযোগ। এই মুহূর্ত যেন শেষ না হয়। হ্যা, এটাই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি কোনো গায়িকা নন. শিল্পী নন. তিনি বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির আবেগ, বাঙালির নস্টালজিয়া, বাঙালির রোমান্স। বাঙালির প্রেম, বিরহ সবকিছু। কোনো পুরস্কার কখনো পারে সন্ধ্যাকালের আকাশকে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাতে ? সন্ধ্যাতারার আলোর ঝলকানি মাপবে কোন পুরস্কার? কোন উপাধি?
না, পারে না. মৃত্যুও বোধহয় পারে না। আজ নশ্বর দেহটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু এই জীবনের কি দোয়েল কোকিলকে স্তব্ধ করতে পারে? বাঙালির প্রতিটা সকাল মানেই সন্ধ্যা আসবেই। সন্ধ্যা নামবে, সন্ধ্যা থাকবে আমাদের ভালোবাসায়, জীবনে, মরণে।
মায়ামৃগ হয়ে। জীবনমৃত্যুর চুয়াপাওয়া র ওপরে ওঠে সূর্যকন্যার মতো। প্রতিটা প্রেমাস্পদর সপ্তপদির শেষ অংক মেলাবেন এই সূর্যশিখা।
সময়ের নিয়মে পৃথিবীতে আঁধারের ধূপছায়া নামবেই। জানি গুঞ্জনও থেমে যাবে। কিন্তু যতদিন প্রেম থাকবে ততদিন, হ্যা ততদিন কানে তবু রবে সন্ধ্যার রেশ তো। বেশ তো।