বগটুই: গিলে খেতে আসছিল গ্রামটা । মাটি লেপা রাস্তাটার দু-পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বালি-পাথর । ইটের স্তূপ । লোক বলতে উর্দিধারীরা । রয়েছেন জলপাই রাঙা পোশাকের লোকগুলোও । হাতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক । দুই পা হাঁটতেই রক্তরাঙা চোখগুলো কটমট করে তাকিয়ে উঠল । ঠিক তখনই । দূর থেকে টোটোর ভোঁ-এ একটু হলেও সাহস দিল… আমজনতা এক জন হলেও আছেন এই গ্রামে ।
রামপুরহাটের বগটুই গ্রাম । সাত দিন আগেও লোকচক্ষুর বাইরে ছিল যার ঠাঁই । আজ সেই গ্রামই খবরের শিরোনামে । ফের সোমবার আসতে চলেছে । মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন । আশ্বাস দিয়েছেন । নিরাপত্তার কথা বলেছেন । তাও কিন্তু, পোড়া গন্ধ-রক্তের ছোপ বগটুইয়ের রাস্তা থেকে মুছে যায়নি । বাড়িগুলো তালা বন্ধ । রাস্তায় মানুষ তো দূরের কথা, কুকুর-ছাগলের দেখাও মেলে না ।
হাতে সংবাদ মাধ্যমের বুম দেখে পথ আটকালেন উর্দিধারীরা । দু-চারটে রুটিন প্রশ্ন । সহজেই ছেড়ে দিলেন । এক লহমায় মনে পড়ে গেল উত্তরপ্রদেশের হাথরসের সেই দিনগুলোর কথা । যেখানে দেশের সংবাদ মাধ্যমের পথ রুখতে দেখা গিয়েছিল যোগীর পুলিস । চিত্র গ্রাহককে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগলাম । যত দূর চোখ গেল, সবই ফাঁকা । বাড়িগুলোতে ঝুলছে বড় বড় তালা । কালো পাখিগুলো উদভ্রান্তের মতো বন্ধ জানালা দিয়ে উঁকি মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । দিন কয়েক আগেও সকাল-দুপুরের রুটিন করে খাবার মিলত যে…
আরও পড়ুন: Rampurhat Violence HC: রামপুরহাট হত্যাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট
তালাবন্ধ ঘর
বেশ কিছুটা একাই চললাম । অবশেষে । চোখে পড়ল তিনটি প্রাণী । খুব সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের পর বাড়ি ফিরেছেন । সামনের জায়গাটায় একটু ঝাড়ু দিচ্ছিলেন । গত ক’দিনের জমে থাকা ধুলে সরানোর এক আপ্রাণ চেষ্টা । সংবাদ মাধ্যমর বুম দেখতেই মাথায় জড়ানো গামছা নেমে এল মুখে । এক ঝটকায় উত্তর, আমি কিছু জানি না ।
একটু দূরে বাড়ির দরজা রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মোতি শেখ । পালালেন না বটে । তবে সব প্রশ্নের খোলামেলা উত্তরও এড়িয়ে গেলেন । কথার ফাঁকে বোঝাই গেল, আশ্বাস মিলেছে, পুলিস পিকেট বসেছে, কিন্তু, সোমের সেই রাতের বাঁচার আকুতি এখনও কানে বাজছে । জীবন্ত প্রাণগুলোকে পুড়তে দেখার আতঙ্ক চোখে মুখে ।
পাশ কাটিয়ে বড় রাস্তায় আসা গেল । তখনও রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিস লেখা কালো রঙের গাড়িগুলো । সেই বাড়িটার সামনে যেতেই নজরে এল প্রহরা যেন আরও বেড়েছে । রাস্তা মুড়ে রয়েছে সিসিটিভিতে । হাই কোর্টের নির্দেশ-অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে রাজ্য পুলিস-প্রশাসন । নিরাপত্তার কোনও খামতি রাখা হয়নি । কোনও সূত্র যেন না চুরি হয়, সে জন্য সতর্ক পুলিস । জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে নীল রাঙা লোহার ব্যারিকেডগুলো দিয়ে ।
আরও পড়ুন: Rampurhat Violence: মমতার নির্দেশের পরই নিরাপত্তা বাড়ল বগটুইয়ে, গ্রামে টহল ডিজির
শ-খানেক পুলিসের মাঝেই দেখা মিলল অন্তরা বিবির। মোতির মতো তার মুখেও ক্লান্তির ছাপ । আতঙ্কের ছবি । জানালেন, আপাতত এলাকায় রয়েছে তিনটি পরিবার । বাকিরা সবই ঘরছাড়া । ফিরবে কবে, কোনও নিশ্চয়তা নেই । পুলিস চলে গেলে কী হবে… সেই প্রশ্নও ঘুরে ফিরে আসছে বার বার ।
শুনশান রাস্তা
বেশ কিছু আধা তৈরি বাড়িও নজর এড়িয়ে যাবে না । বালি-ইটের ছড়িয়ে থাকা অবস্থান বুঝিয়ে দিচ্ছে—কাজ এখনও অনেকটাই বাকি । মঙ্গলবার থেকে সব বন্ধ । কোনও বাড়ির উপর তলায় কাঠ-বাঁশের কাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছিল । সব ঠিক থাকলে এত দিনে ঢালাই হয়ে যেত । সোমবারের অশান্তি ওলোটপালট করে দিয়েছে । আট মৃত্যুর কান্না ঢালাই করে দিয়েছে নতুন বাড়ির স্বপ্ন । বন্ধ করে দিয়েছে জীবনের স্বাভাবিক শ্বাস । বাতাসে এখনও পোড়া গন্ধ । মনে এখনও আতঙ্ক ।