কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক : গত বছর ৩ টি নতুন কৃষি আইন পাস করেছিল কেন্দ্র। মোদি সরকারের এই আইনের বিরোধিতা করে গত এক বছর ধরে রাজপথে নেমে লাগাতার আন্দোলন করছেন কৃষকরা। শুক্রবার এক বছর পর কৃষকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করল কেন্দ্র। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে গুরুনানকের জন্ম জয়ন্তীতে ৩ কৃষি আইন প্রত্যাহার করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কৃষকদের এই জয়ের পথ মোটেই সহজ ছিল না। গত বছরের ২৫ নভেম্বরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ‘দিল্লি চলো’ শিবিরের অংশ হিসাবে। সেই দিন আইন সম্পূর্ণ বাতিলের দাবিতে হাজার হাজার কৃষক – প্রধানত পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকে – রাজধানীর উদ্দেশে মিছিল করেছিল।
কেমন ছিল এই আন্দোলন? দেখে নিন এক ঝলকে
৫ জুন ২০২০ – কেন্দ্রের তরফে তিনটি কৃষি আইন নিয়ে আসা হয়। যেগুলি হল,
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০- অধ্যাদেশ আনা হয় সংসদে
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ – লোকসভায় পাস করানো হয় অধ্যাদেশ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২০- ধ্বনিভোটে রাজ্যসভায় এই অধ্যাদেশ পাস হয়
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ – পঞ্জাবের কৃষকেরা ৩ দিনের রেল রোকো কর্মসূচির ডাক দেয়
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ – এই বিলের বিরোধিতা করে সর্বভারতীয় কিষাণ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এই কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারত জুড়ে কৃষকরা রাস্তায় নেমে পড়েন।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ – ফার্ম বিলগুলিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে কৃষি আইনে পরিণত করা হয়।
২৫ নভেম্বর ২০২০- নতুন খামার আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভের পর ৩ নভেম্বর দেশব্যাপী রাস্তা অবরোধ সহ, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষক ইউনিয়নগুলি ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের ডাক দেয়। তবে, করোনা বিধির কারণে দিল্লি পুলিশ রাজধানীতে ঢোকার আগেই কৃষকদের আটকে দেয়।
২৬ নভেম্বর ২০২০- কৃষকেরা দিল্লির দিকে এগোতে গেলে হরিয়ানার আম্বালা জেলায় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। ছোঁড়া হয় জল কামান, টিয়ার গ্যাস। পরে উত্তর-পশ্চিম দিল্লির নিরঙ্কারি মাঠে তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার জন্য পুলিশ তাদের দিল্লিতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়।
২৮ নভেম্বর ২০২০- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কৃষকদের সাথে আলোচনা করার প্রস্তাব দেন। তবে কৃষকরা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
২৯ নভেম্বর ২০২০ – মোদি তার মন কি বাত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সমস্ত রাজনৈতিক দল কৃষকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তার সরকারই শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে।
৩ ডিসেম্বর ২০২০- সরকার কৃষকদের প্রতিনিধিদের সাথে প্রথম দফা আলোচনা করে। যদিও কোনও সমাধানসূত্র পাওয়া যায়নি।
৫ ডিসেম্বর ২০২০ – কৃষক এবং কেন্দ্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়। যদিও সেই আলোচনাও নিষ্ফল ছিল।
৮ ডিসেম্বর ২০২০- কৃষকরা ভারত বন্ধের ডাক দেয়। অন্যান্য রাজ্যের কৃষকরাও তাদের আহ্বানে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
৯ ডিসেম্বর ২০২০ – কৃষি আইন সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হলে তা ফিরিয়ে দেন কৃষকরা।
১১ ডিসেম্বর ২০২০ – ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন এই তিন আইনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়।
১৩ ডিসেম্বর ২০২০ – কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ কৃষক বিক্ষোভে ‘টুকডে টুকডে’ গ্যাংয়ের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন।
৪ জানুয়ারি, ২০২১- কৃষকদের সঙ্গে সরকার সপ্তম দফা আলোচনা করে। সেই আলচনাও ব্যর্থ হয়।
১২ জানুয়ারী ২০২১- সুপ্রিম কোর্ট তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাস্তবায়নে স্থগিতাদেশ দেয়। এছাড়াও একটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি সরকার ও কৃষক পক্ষের মধ্যে সমাধানসূত্র বের করার চেষ্টা করবে।
২৬ জানুয়ারী ২০২১- প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ২৬ জানুয়ারী কৃষক ইউনিয়নগুলি ট্র্যাক্টর মিছিল ডাকে। যে ট্র্যাক্টর মিছিলে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। রাজধানীতে প্রবেশ করে কৃষকদের একাংশ লাল কেল্লায় উঠে পড়ে। লাল কেল্লার উপর থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার মতও অভিযোগ ওঠে।
রাজধানীতে কৃষক আন্দোলন
৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ – কৃষক বিক্ষোভের সমর্থন করে টুইট করার কারণে আমেরিকার পপ তারকা রিহানা, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বোনঝি মীনা হ্যারিসনের তীব্র নিন্দা করে। তাঁদের পদক্ষেপকেও ভুল বলা হয়।
৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ – দিল্লি পুলিশের সাইবার-ক্রাইম সেল কৃষক বিক্ষোভে একটি ‘টুলকিট’ তৈরি করার কারণে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’, ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’ এবং ‘বিদ্বেষ প্রচার করার’ অভিযোগে একটি এফআইআর দায়ের করে। পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গে সাহাজ্য করার জন্য গ্রেফতার করা হয় দিশা রবিকে।
৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১- প্রতিবাদী কৃষকরা দুপুর ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত তিন ঘন্টার জন্য দেশব্যাপী ‘চাক্কা জাম’ বা রাস্তা অবরোধ করে। সেই সময়ে পঞ্জাব এবং হরিয়ানা জুড়ে বেশ কয়েকটি রাস্তা অবরুদ্ধ করা হয়।
৬ মার্চ ২০২১- দিল্লি বর্ডারে কৃষক আন্দোলনের ১০০ দিন পূর্ণ হয়।
৮ মার্চ ২০২১ – সিঙ্ঘু সীমান্তের প্রতিবাদ স্থলের কাছে গুলি চালানো হয়। কেউ আহত হয় না।
২৭ মে ২০২১- কৃষকরা আন্দোলনের ছয় মাস উপলক্ষে ‘কালো দিবস’ পালন করা হয়। সরকারের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। এদিন কৃষক নেতারা বলেন, তাদের দাবি পূরণ না হলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকাইত জানিয়েছিলেন, এই তিনটি কৃষি আইন বাতিল হয়ে গেলেই কৃষকরা বিক্ষোভ প্রত্যাহার করবে।
ছয় মাস উপলক্ষে একটি ‘কালো দিবস’ পালন করা হয়
জুলাই ২০২১- সংসদে বাদল অধিবেশন শুরু হয়। ২০০ জন আন্দোলনকারী কৃষক সংসদ ভবনের বাইরে অধিবেশন শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল বিরোধীরাও।
কৃষকদের সঙ্গে বিরোধীরা
৭ অগাস্ট ২০২১- ১৪ টি বিরোধী দলের নেতারা সংসদ ভবনে মিলিত হন এবং দিল্লির যন্তর মন্তরে কিষান সংসদ পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নেন।
কৃষি বিলের বিরধিতায় বিরোধীরা
২৮ আগস্ট ২০২১ – এক বছর আগে তৈরি হওয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন আবার জনসমক্ষে আসে। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিজেপির একটি সভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় হরিয়ানা পুলিশ কর্নালে কৃষকদের উপর লাঠি চালায়। যে ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়। করে, জাতীয় সড়কের বস্তারা টোল প্লাজায় লাঠিচার্জে বেশ কয়েকজন আহত হয়।
করনালে কৃষকদের উপর লাঠি চার্জ
৩ অক্টোবর ২০২১ – উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে আট জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে চার জন কৃষক এবং এক সাংবাদিকের উপর দিয়ে গাড়ি পিষে দেয় বলে অভিযোগ। অভিযোগ ওই গাড়িতে ছিলেন অভিযুক্ত আশিস মিশ্র এবং তাঁর সঙ্গী অঙ্কিত দাস। এই ঘটনার পরই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় লখিমপুর। পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি চলে। পুলিশ তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলে আশিস মিশ্র সহ তেরো জনকে গ্রেফতার করে। এরপর লখিমপুর কাণ্ডে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলের ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ।
কৃষকদের মিছিলে গাড়ি, উত্তপ্ত লখিমপুর
১৯ নভেম্বর ২০২১: কৃষকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নিল কেন্দ্র। অবশেষে টানা এক বছর আন্দোলনের পর কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে নিল সরকার। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে গুরুনানকের জন্ম জয়ন্তীতে ৩ কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কৃষিআইন বাতিলের খুশিতে উৎসবের মেজাজে কৃষকরা