শ্রীমান তপেশ মিত্র, মানে আমাদের তোপসে তো কিনেছেই, ফেলুদাও
মগজাস্ত্র শান দিতে কখনও কিনেছেন বোধ করি। হাওড়া স্টেশনের টিংটং
শব্দের পর ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা হচ্ছে।প্রদোষ মিত্তির চারমিনার ধরিয়ে হুইলারের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বিদেশি বইয়ের পাতা উলটে পালটে দেখছেন। ধোঁয়ার রিং ছাড়ছেন। তোপসে খুঁজছে
‘সাহারায় শিহরণ’। লালমোহনবাবু ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। এ রকম দৃশ্য বাঙালি মন, কল্পনাকে বেশ আরাম দেয়। তাই এ রকম বাঙালি খুঁজে পাওয়া দায়। যিনি একবারও হাওড়া, শিয়ালদহ বা অন্য কোনও বড় স্টেশনে হুইলারের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়াননি। না কিনলেও, অন্তত বইয়ের পাতা উলটে দেখেননি। আর ছোটরা তো ‘নন্টে ফন্টে’, ‘চাঁদমামা’, ‘বেতাল’ কিনেই উঠে পড়ত উপরের বার্থে। সেখানে তাদের নিজস্ব গুহা।
শিয়ালদহ স্টেশনে হুইলারের স্টলে বিকোচ্ছে রুমাল, মোবাইল৷
সেই দিন বদলেছে। একেবারে সাবেকি পুরনো হুইলারের স্টলগুলো আপাতত ঝাঁপবন্ধ হেরিটেজ সাইট। আবার বেশ কিছু হুইলার তাদের ভোল পালটে ফেলেছে। হুইলারের স্টল এখন মালটিপারপাস স্টোর। সেখানে সব কিছুই বিক্রি হচ্ছে। শুধু বই ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে। অথবা এক কোনে পড়ে রয়েছে খুচরো চেতন ভগত।
ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা ‘এ এইচ হুইলার কোং প্রাইভেট লিমিটেড’-এর স্টল। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। আঠারো শতকের মোটামুটি শেষের দিকে স্টেশনে স্টেশনে এ রকম বুক স্টল চালু হয়। বই তো বটেই পাওয়া যেত দেশি-বিদেশি খবরের কাগজও। ট্রেনযাত্রার পথে ইংরেজ বাবুরা টুপি, ছড়ি আর খবর কাগজটি সঙ্গে রাখতেন। বাঙালি পাঠক জেনে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠবেন, প্ল্যাটফর্মে চাকাগাড়ির উপর বই বিক্রির এই অভিনব ভাবনার পিছনে একজন বাঙালিও ছিলেন। আর ছিলেন এক ফরাসি। এমিলি মোরেয়ু আর টি কে ব্যানার্জি। দুই বন্ধুতে মিলে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন হুইলারের চাকা।
শিয়ালদহ স্টেশনে হুইলারের স্টলে বিকোচ্ছে রুমাল, মোবাইল৷
কলকাতা টিভি জিডিটালের এখনকার গন্তব্য শিয়ালদহ স্টেশন। স্টল নম্বর দুই বাই পাঁচ। স্টলের মাথায়, সাইন বোর্ডে ‘এ এইচ হুইলার কোং প্রাইভেট লিমিটেড’ লেখা। তাতে ফ্লুরোসেন্ট আলো এসে পড়েছে। জলের বোতল, কেক-বিস্কুটের প্যাকেট, নানান স্বাদের ঠান্ডা পানিয়, চকোলেট, চিপস্, মায় রুমালও বিকোচ্ছে। ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থাও আছে। শুধু বই দেখতে হলে সঙ্গে দুরবীন নিয়ে যেতে হবে। সেই রঙিন ঝলমলে কমিকস-এর বইগুলো তবে সব গেল কোথায়? বড়রা কি এখন আর ট্রেনজার্নিতে হ্যারল্ড রবিনস্ পড়েন না? বা শিডনি শেলডন? মোবাইল কি কেড়ে নিল উপরের বার্থে শুয়ে একা একা বই পড়ার নস্টালজিক ভ্রমণের সেই দিন-রাতগুলো?