নির্বাচনী ধাক্কার ‘আফটার শক’, ক্রমশ কাহিল হয়ে পড়ছে বাংলার গেরুয়া শিবির। দলের কার্যকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণের রাশ আলগা হচ্ছে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের। দলের কেন্দ্রীয় নেতা মুকুল রায় বস্তুত গোঁসা ঘরে। সভাপতির বৈঠকে একগুচ্ছ নেতার গরহাজিরা। বাধ্য হয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় কমিটি গড়েছেন তিনি। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশে বাড়তি মাত্রা এনেছেন আরএসএসের শীর্ষ কর্তাদের আস্থাভাজন রন্তিদেব সেনগুপ্তের রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা। শুধু রাজনীতি ত্যাগ নয়,বিজেপি তথা সঙ্ঘের মতাদর্শকেই ঘুরিয়ে সমালোচনায় বিঁধেছেন তিনি।
অনেক নেতা মায়,সাংসদ পর্যন্ত বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বৈঠক এড়িয়ে লুকিয়ে চুড়িয়ে মুকুলের সঙ্গে দেখা করছেন। জেলায় জেলায় বিজেপি কর্মীদের বিক্ষোভ বাড়ছে। অবস্থা এমনই, বিধানসভায় যে ৭৫ জন সদস্য রয়েছেন,তাদের কতজন শেষ পর্যন্ত দলে টিকে থাকবেন, তা নিয়েও সংশয় দেকা দিয়েছে। সাবেক ও ‘তৎকাল’ বিজেপি সংঘাত তো ভোট পর্বেই প্রকাশ্যে এসে পড়েছিলো। এখন তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সাংগঠনিক এই ছন্নছাড়া আবহেই বিরোধীদের তোলা অভিযোগের সুরেই বিজেপি ত্যাগের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় কবুল করলেন দলের বুদ্ধিজীবী শাখার অন্যতম সংগঠক রন্তিদেব সেনগুপ্ত। শুধু বিজেপি নয়, রন্তিদেব কিন্তু নাগপুরের সংঘাধিপতি মোহন ভগবতের ঘনিষ্ঠ। স্বভাবতই, উপর্যুপরি দু-দুবার পদ্ম প্রতীকে ভোটে লড়ে ব্যর্থ রন্তিদেবের প্রকাশ্যে রাজনীতি ত্যাগের ঘোষণা তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা দখল করতে মরিয়া বিজেপি জলের মতো টাকা খরচ করে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে ময়দানে নামিয়েছিল। পাশাপাশি কেন্দ্রের একাধিক এজেন্সিকে দিয়ে রাজ্যের শাসক দলের ওপর চাপ তৈরি করেও নির্বাচনে ভরাডুবি রুখতে পারেনি। উল্টে পরাজয়ের জেরে একদিকে চরম হতাশা, অন্যদিকে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা গ্রাস করেছে বাংলার বিজেপিকে। নিজেদের সংগঠন নয়, অন্যান্য দল ভাঙিয়ে ঘর গোছানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুরা। একদা তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল রায়কে দলে টেনেই তৃণমূলকে তছনছ করার পরিকল্পনা ছিল বিজেপির। শুধু বাংলার নয়, দিল্লির দীনদয়াল ভবনের তৈরি করা নকশা অনুসারেই সেই দল ভাঙানোর আগ্রাসী খেলা চলে। তৃণমূলের দুর্নীতিতে কলঙ্কিত নেতা-নেত্রীদের জন্য দরজা খুলে রেখেছিল বিজেপি। ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ হয়েই ফের সেই দল বদল করা নেতারা পুনরায় দলত্যাগে তৎপর হয়ে উঠেছেন। মুকুলকে নিয়ে নানা জল্পনা। গত নির্বাচনে তাঁদের দাদাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি- এই অনুযোগ তৃণমূল থেকে যাওয়া বিজেপি কর্মীদের। তাঁরা রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের ধরাধরি করতে শুরু করেছেন। একাংশের মতে, দাদার ‘পরামর্শেই’ তাঁরা দল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পুরানো দলে ফিরতে আগ্রহী তাঁরা। বিজেপির এমনই বেহাল দশা। এরই মধ্যে রন্তিদেব সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন, ‘রাজনীতি মুক্ত চিন্তাকে হত্যা করে’। তাঁর এই উপলব্ধি বিজেপির মতাদর্শকেই যেন বেআব্রু করে দিয়েছে।
একদা বাম পরিবারের সদস্য এই প্রবীণ সাংবাদিকের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের শীর্ষ স্থানীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত। আরএসএসের সরসঙ্ঘ চালক মোহন ভগবৎ কলকাতায় একাধিকবার রন্তিদেবের উল্টোডাঙার আবাসনএ গিয়েছেন। মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ছবিও সেঁটেছিলেন রন্তিদেব স্বয়ং। শুধু কি তাই, আরএসএসের রাজ্য মুখপাত্র স্বস্তিকার সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁকে ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে হাওড়ায় প্রার্থী করে বিজেপি। সেই ভোটে হেরে গেলেও ফের গত বিধানসভায় তাঁকে প্রার্থী করা হয়। প্রথমে ভোটে লড়তে অস্বীকার করলেও সূত্রের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে প্রার্থী হন। পরাজয়ের ধারা অব্যাহত। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে ‘বেসুরো’ হচ্ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে ব্যক্তিগত কিছু কথা ব্যক্ত করার ছলে সংক্ষেপে যা বলেছেন তাতে বিজেপি তো বটেই কেশব ভবন থেকে নাগপুরের কেশব কুঞ্জকেও বিড়ম্বনায় ফেলবে। উল্লেখ্য, সঙ্ঘের তৃতীয় বর্ষ শিক্ষাবর্গের শেষে নাগপুরে সদর দফতরে সমাবর্তনে একবার দীক্ষান্ত ভাষণ দিতে ডাক পেয়েছিলেন রন্তিদেব সেনগুপ্ত। সঙ্ঘের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের নিরিখে সরসঙ্ঘ চালকের ব্যক্তিগত উদ্যোগেই স্বল্প সময়ে রন্তিদেবের এই উত্থান। এ হেন স্বয়ং সেবক আজ জানিয়েছেন তিনি এখন মুক্ত চিন্তার অনুসারী। ‘রাজনীতি তা যে পক্ষেরই হোক না কেন, তা আসলো মুক্ত চিন্তাকে হত্যা করে। আমি সেই বন্ধ্যাত্বের জগতে আর ফিরতে চাই না।’ এই অবস্থায় দিলীপের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির বিশল্যকরনি কি বাংলা বিজেপির ক্ষয় রুখতে পারবে?