যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। দিলু ঘোষ নামেই তিনি পরিচিত এই বাংলার রাজনৈতিক মহলে, এবং এটাও জানেন যে ওনার আপাতত এনিমি নাম্বার ওয়ান মমতা নয়, তৃণমূল নয়, শুভেন্দু অধিকারী। মুখে না বললেও কে যে ওনাকে কাঠিবাজি করে হারিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তো সেই শুভেন্দু অধিকারী এই বাংলাদেশ এপিসোডে মুহূর্মুহু গোলা দাগছেন। নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের জ্যান্ত জ্বালানো হচ্ছে, ওদিকে মণিপুরে আদিবাসি কুকি রমণীদের নগ্ন করে প্যারেড করানো হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে, ওদিকে নকশালপন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের নামে ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের খুন করা হচ্ছে, কুম্ভ মেলায় ফতোয়া জারি হয়েছে মুসলমানরা দোকান দিতেও পারবে না। সেদিকে নজর নেই, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য কেঁদে আকুল, আমরা গোদা বাংলায় একে কুমিরের কান্না বলে থাকি। কিন্তু তিনি এই রাজ্যের এক নম্বর বিজেপি নেতা হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন, টিকে থাকার জন্যই, ঢাকা দখল করব গোছের হুমকি থেকে নানান কথা বলছেন, কাজেই দিলীপ ঘোষকেও কিছু তো বলতেই হয়, তো তিনি জানিয়েছেন বাংলাদেশের পণ্য বয়কট করা হবে।
তো জানা গেল যে দিলু ঘোষ এতদিন বাংলাদেশের বহু পণ্য ব্যবহার করতেন, এবারে তা বয়কট করবেন। লিস্টটা পেলে ভালো হত, কিন্তু সে লিস্ট উনি দেননি। অবশ্য এমন হুমকি আমরা এর আগে বিজেপির বড় নেতাদের মুখেও শুনেছি, সেটা অবশ্য ছিল চীনের পণ্য বয়কটের কথা। এদিকে আপাতত ভারতবর্ষের সস্তা ইলেক্ট্রনিকস, বাল্ব আর খেলনার বাজারের খুব কনজারভেটিভ হিসেবেও ৮০ শতাংশ দখল করেছে চীন, আর তা বাড়ছে, কমার কোনও লক্ষণ নেই। এবং সেই চীন বয়কটের মধ্যেই এসে গেল বাংলাদেশ বয়কটের কথা। ইতিমধ্যেই বগলের ফোঁড়া অপারেশনেও লাখখানেক কামিয়ে নেওয়া বাইপাস, নিউটাউন, সল্টলেক ইত্যাদি অঞ্চলের হাসপাতালে হাহাকার শোনা যাচ্ছে। কেবল হাসপাতাল নয়, পাশের রেস্তরাঁ, হোটেল, ভাড়ায় ফ্ল্যাট দিতেন যাঁরা তাঁদের ঘটি উল্টেছে, নিউ মার্কেটের আশেপাশে হোটেল আর রেস্তরাঁতে মাছি ঘুরছে, এসব খবর অবশ্য দিলীপ ঘোষের জানাই নেই। জানাই নেই যে ওনার সরকারের মানে মোদি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ঢাকায় গিয়ে বৈঠক করছেন, দু’ দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন, বাংলাদেশের তরফেও সেই কথা বলা হচ্ছে। সেই সময়ে দিলুবাবু কেবল শুভেন্দু অধিকারীর থেকে বেশি পয়েন্ট পাওয়ার জন্য বিষ উগরোচ্ছেন। আমরা বলি কি দিলু বাবু আপনি বরং সেই বাংলাদেশি পণ্যের একটা তালিকা দিন, যেগুলো আপনি ব্যবহার করতেন, তারপর সেগুলো নিয়ে কথা হবে।
আরও পড়ুন: হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানো উচিত? নাকি এই দেশেই রাখা উচিত?
এবার আসুন এই বয়কটকে আর এক দিক থেকে দেখা যাক। বয়কটে কাদের লাভ, কাদের ক্ষতি, আর সেই বয়কটের ইতিহাসেও চোখ রাখা যাক। ১৮৮০ সালে আইরিশ জমি আন্দোলনের নেতারা ব্রিটিশ এস্টেট ম্যানেজার চার্লস কানিংহাম বয়কটকে একঘরে করার আন্দোলন শুরু করেন, আর সেই আন্দোলন থেকেই এই বয়কট শব্দের প্রচলন হয়। মানে খুব পরিষ্কার, আমরা বর্জন করব। আমাদের দেশে বাংলা ভাগকে কেন্দ্র করে ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়, গান্ধীজি দেশে আসার অনেক আগেই, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, জমিদার ইত্যাদিদের সমর্থনে বয়কট শুরু তো হল, কিন্তু তাতে সাধারণ গরিব মানুষজন অংশ নিলেন না, কেন? কারণ মিলের ধুতির দাম কম, কাহদির ধুতির দাম বেশি, বিদেশি কাপড়জামার দাম দেশে তৈরি জামাকাপড়ের চেয়ে অনেক কম ছিল, গরিব মানুষেরা এই বিদেশি কাপড় জামা বয়কট ইত্যাদিকে বাবুদের বিলাসিতা বলেই মনে করলেন। মাথায় রাখুন এর অনেক পরে গান্ধীজি যখন সিভিল ডিজওবিডিয়েন্স, সামাজিক অবাধ্যতার কথা বলছেন, তখন বয়কটের অনুরোধ করছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন না।
আর রবি ঠাকুর, তিনি এই স্বদেশি আর বয়কট নিয়ে কী বলেছিলেন? প্রথমে এই স্বদেশি আন্দোলনের তিনিই ছিলেন অন্যতম হোতা, বয়কটের ডাকও উনি দিয়েছিলেন, কিছুদিন পরেই সেই বয়কট আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলনের আসল ছবি তাঁর সামনে এসে পড়ে। তিনি বলেন, “আজ আমাদের ইংরেজী পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে ‘আমরা উভয়ে ভাই’—তখন এই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুতেই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’ বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্ণমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে-দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি আস্পর্দ্দা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত স্বদেশী প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। এই বাবুদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, কিছু সুবিধার জন্য ঐক্যের কথা বলা এবং ঐক্যের আগ্রহে হৃদয়ের যোগ না থাকায় এই বয়কট বা স্বরাজের আন্দোলনটা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে উঠেছে।” দিলু ঘোষ অবশ্য এত ভেবেচিন্তে কোনও কথা বলেছেন এটা তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষও বিশ্বাস করবেন না, উনি বলেছেন মাত্র। আসলে দিলুদা ইলিশ মাছ খান না, নিরামিষই পছন্দ আর জিনসের প্যান্ট পরেন না। এদিকে এই দুটি জিনিস, আমাদের আমজনতা বাংলাদেশের কাছ থেকে পায়, এক হল, ইলিশ, দুই হল জামাকাপড়। ইলিশখেকো এপার বাংলার বাঙালি কি দিলু বাবুর বয়কটে কান দেবে? বা প্রশ্নটা এরকমও হতেই পারে যে দিলু বাবুর এহেন বয়কটের কথায় আম বাঙালি খচে যাবে না তো?
The post দিলীপ ঘোষের বাংলাদেশের মাল বয়কট সত্যি মিথ্যে কথাগুলো first appeared on KolkataTV.
The post দিলীপ ঘোষের বাংলাদেশের মাল বয়কট সত্যি মিথ্যে কথাগুলো appeared first on KolkataTV.