সেই মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পড়ছে, যিনি হাইট ৬ ফুট আর রং ফরসা দেখেই এক ছাত্রকে রাজার পার্ট দিয়েছিলেন, স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের নাটকে। তারপর সেই অনুষ্ঠানের দিনে রাজপোশাকে সাজগোজ করে সেই ছেলেটি স্টেজে এসে পার্ট ভুলে রাজার বদলে কোতোয়ালের ডায়লগ বলতে শুরু করেছিল এবং তারপর আরও ঘাবড়ে ওই স্টেজেই ভ্যাঁ করে কাঁদতে বসেছিল। মাস্টারমশাই কপাল চাপড়িয়ে বলেছিলেন, কাকে দিয়েছি রাজার পার্ট। দিল্লিতে বসে অমিত শাহ নিশ্চয়ই এই কথাটাই বলছেন, কাকে দিয়েছি রাজার পার্ট? শুধু তাই নয়, রাজার এই ধ্যাড়ানো দেখে পুলকিত দিলু ঘোষ এবং সুকান্ত মজুমদার লবিও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে, কাকে দেওয়া হয়েছে রাজার পার্ট? একটা কথা মোটামুটি সত্যি এবং প্রচলিতও বটে, তৃণমূলকে তৃণমূলই হারাতে পারে, ওই গব্বর সিংয়ের মতন খানিকটা। তো সেই ফর্মুলা মেনেই বিজেপির নেতা দিয়ে কিচ্ছু হবে না ভেবেই কাঁথির খোকাবাবুকে নাকি সিবিআই-এর ভয় দেখিয়ে, জেলের চাক্কি পিসিং পিসিং ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে বিজেপিতে আনা হয়েছিল। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দেখেই তাদের মনে হয়েছিল এবারে বাংলা দখল তো কেবল সময়ের অপেক্ষা। কোথায় কী। তিনি ক্রমাগত হারছেন আর নানান দাবি করছেন। ওকে সিবিআই দিয়ে তোলাতে হবে, তার ঘরে ইনকাম ট্যাক্স রেড করাতে হবে, ওকে এনআইএ দিয়ে ভয় দেখাতে হবে। তো সেসব অক্ষরে অক্ষরে পালন করার পরেও পদ্মফুল ফুটিতেছে না। রাজার পার্ট যে একজন খোজাকে দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারছেন দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব। সেই শুভেন্দু এবারে নিজের এলাকাতেই হেরে ভূত বললেও কম বলা হবে। সেই কবে থেকেই এমনকী বাম জমানাতেও কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্ক ছিল শিশির অধিকারীর হাতে, পরে তা যায় শুভেন্দু অধিকারীর পাতে। সেই সমবায় ব্যাঙ্কের ভোটে হার নয় গোহারান হেরেছেন শুভেন্দু, সেটাই বিষয় আজকে ঘর ভেঙেছে, মুখ পুড়েছে, কাঁথির খোকাবাবুর।
কাঁথি তো অধিকারী পরিবারের দুর্গ, অন্তত মানুষের পার্সেপশন তো সেটাই। সেই কোলাঘাট থেকে নন্দকুমার, এগরা, হেরিয়া, রামনগর, মহিষাদল, পটাশপুর, বেলদা, মারিশদা এসবই তো শুভেন্দু অধিকারীর হাতের তালুর মতো চেনা। সেই চেনা ব্যাটল গ্রাউন্ডে তাঁর বা অধিকারী পরিবারের দখলদারি তো আজকের নয়, বহু যুগের। আর সেই দখলদারি শুরুতে কংগ্রেসের, আর তার পরে তৃণমূলের ছায়াতে থেকেই। কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্কও আজকের নয়, কোটি কোটি টাকার লেনদেন, বিজেপিতে যাওয়ার পরেই হারিয়েছিলেন এই ব্যাঙ্কের কন্ট্রোল। আর তা ফিরে পাওয়ার জন্য কতটা মরিয়া ছিলেন শুভেন্দু?
আরও পড়ুন: Aajke | ডাহা ফেল শুভেন্দু অধিকারী, নেতৃত্ব বিরক্ত
ওনার তো কলকাতা হাইকোর্টে বিশেষ জানাশোনা, উনি আসেন আর রায় নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তো এবারে এলেন আবেদন নিয়ে যে এই সমবায় ব্যাঙ্কের ভোটে আমাকে জোর করে হারানো হবে, তাই কেন্দ্রীয় সুরক্ষা চাই, মানে অমিত শাহজি সিআরপিএফ পাঠান। ভারতবর্ষের কোথাও হয়েছে? হয়নি, কিন্তু ওই যে এক অজানা জাদুমন্ত্রে তিনি আসেন কলকাতা হাইকোর্টে এবং তারপর তিনি যা চান তাই নিয়ে ঘরে ফেরেন। গতবার তো একজন বিচারপতিকেই নিয়ে ফিরেছিলেন, জিতিয়েওছিলেন। তো এবারে সুপ্রিম কোর্টেও রায় ওনার পক্ষে, সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স এল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওই পাঁচ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় রয়েছে আধা সেনা। এ ছাড়াও ১৪টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে মোট ৩০০ সিসি ক্যামেরায় নজরদারি ছিল। প্রতিটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ২০০ মিটার এলাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। প্রতিটি কেন্দ্রের নিরাপত্তায় ৬০ থেকে ৮০ জন পুলিশকর্মী মোতায়েন ছিল। বেশ কয়েকটি এলাকা স্পর্শকাতর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ভোট শেষ, ১০৮টা আসনে তৃণমূল ১০১, বিজেপি ৬ আর নির্দল ১ জন জিতেছেন। ধুয়েমুছে সাফ। কাজেই বিজেপি নেতারা দিল্লিতে বসে ভাবছেন, কাকে দিয়েছি রাজার পার্ট। নিজের উঠান দুয়ারটুকুও সামলে রাখতে পারছে না। এবং সূত্রের খবর ওদিকে দিলু ঘোষ নাকি গতকাল থেকে কেবল ফিকফিক করে হাসছেন, সুকান্ত মজুমদার নাকি বলেছেন বহিরাগতদের নিয়ে দলকে ভাবতে হবে। আর কুণাল ঘোষ নাকি বলেছেন আগে উঠোন সামলা পরে গড়বি বাংলা। কিন্তু কথা হল এরকম হল কেন? কী করে? আর এর ফলে কী হতে পারে? আসলে এলাকার মানুষ ক্রমশ বিজেপির রাজনীতি আর শুভেন্দুর অন্ধ মমতা বিরোধিতাকে মেনে নিচ্ছে না। প্রাথমিকভাবেও যাঁরা শুভেন্দুর সঙ্গে ছিলেন তাঁরাও এখন বুঝতে পারছেন এ রাজ্যে বিজেপির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এদিকে যাঁরা শুভেন্দুর সঙ্গে গিয়েছিলেন, তাঁরা তো মুখ দেখতে যাননি, ৯০ শতাংশ গিয়েছিলেন ধান্দাপানির জন্য, সেটাই যদি না হয় তো থেকে কী লাভ? কাজেই তাঁরা আবার ঘরে ফিরছেন। শুভেন্দু জনে জনে বুঝিয়েছিলেন ২০১৯-এর পরে ২০২১-এ ক্ষমতায় আসছেন, হয়নি। ২০২৪-এ আবার বড় হার, কাজেই মানুষজন আর তাঁর উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না। আর এই ব্যাঙ্কের কন্ট্রোল না থাকার মানে হচ্ছে আরও বহু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা, ট্রলার ব্যবসায়ী থেকে মাছ ব্যবসায়ী থেকে এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে এই ব্যাঙ্কের সঙ্গে, সেটাও কম কথা নয়। এতদিন শুভেন্দু বুঝিয়েছিলেন ভোট হলেই ব্যাঙ্ক ওনার, এখন দেখা যাচ্ছে ওনার হাতে কিছুই নেই, কাজেই ওই মানুষগুলোও আবার তৃণমূল-মুখো হবেন। সবমিলিয়ে ঘরও ভেঙেছে, মুখও পুড়েছে শুভেন্দুর। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, শুভেন্দুর নিজের গড়ে ১০৮টা আসনে ৬টাতে বিজেপি জিতল, কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্ক রইল তৃণমূলের দখলে, এর ফলে কি শুভেন্দু বিজেপির রাজনীতিতেও ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
ওদিকে গত ২৭ অক্টোবর থেকে রাজ্যজুড়ে বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি, দুই সাংগঠনিক জেলাতেই অভিযানে সাড়া আসছিল না। রবিবার সদস্য সংগ্রহ অভিযানের শেষ দিনে দেখা যাচ্ছে, জেলা জুড়ে লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি বিজেপি। তমলুক ও কাঁথি, দুই সাংগঠনিক জেলাতেই তিন লক্ষ করে নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু অর্ধেকও পূরণ হয়নি। বিজেপির দলীয় সূত্রে খবর, ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তমলুক সাংগঠনিক জেলায় সদস্য সংগ্রহ হয়েছে ৯৮,২৮৩ জন। আর কাঁথিতে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সদস্য সংগ্রহ হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার। যা লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশ মাত্র। রবিবার সদস্য বাড়ানোর জন্য রাস্তায় নামার কথা ছিল, তার মধ্যেই এল এই প্রকাণ্ড হারের খবর, অতএব রাস্তাতে না নেমে তাঁরা ফিরে গেছেন ঘরে। মানে ১০০-র মধ্যে পাশ মার্কটুকুও জোগাড় করতে পারলেন না ফেল্টুস শুভেন্দু অধিকারী। তবে সান্ত্বনা এটাই যে অন্য জেলার থেকে নাকি তাঁরা এগিয়ে, মানে কানার মধ্যে ঝাপসা, সেই সার্টিফিকেট নিয়েই আপাতত সন্তুষ্ট থাকতে হবে কাঁথির খোকাবাবুকে।
The post Aajke | ঘর ভেঙেছে, মুখ পুড়েছে, কাঁথির খোকাবাবুর first appeared on KolkataTV.
The post Aajke | ঘর ভেঙেছে, মুখ পুড়েছে, কাঁথির খোকাবাবুর appeared first on KolkataTV.