মহিষাদল: প্রাচীন রীতিনীতি মেনে মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদের দিন থেকেই শুরু হয় পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ির ২৫০ বছরের দুর্গাপুজো (Mahishadal Rajbari Durga Puja)। রাজাদের সেকেলে রাজত্ব আজ আর নেই। রাজবাড়িতে আজ থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে সেকালের পুজোর নিয়ম কানুন। ঢাক, ঢোল, কাঁসর-ঘন্টা ধ্বনি সহযোগে পুজোর কয়েকদিন চলে মহিষাদল রাজবাড়ির প্রাচীন এই দুর্গাপুজো। তবে এখন আর মহাষ্টমীর দিন কামান দাগা হয় না। নেই সেকেলে পর্দা প্রথাও। তারই মাঝে আজও রাজবাড়ির ঐতিহ্য বহন করে চলে এই পুজো।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে জানা যায়, ১৭৭৮ সালে রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের স্ত্রী রানী জানকির হাত ধরে সূচনা হয় মহিষাদল রাজ পরিবারের দুর্গাপুজোর। এরপর থেকেই ক্রমে ক্রমে প্রজন্মের হাত ধরে চলে আসছে মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো। একসময় এই রাজবাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে উদ্দিপনায় মেতে উঠতেন মহিষাদলসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলির মানুষজন। কিন্তু রাজাদের সেকেলে রাজত্ব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আজ মানুষের মধ্যে হারিয়েছে এই প্রাচীন রাজবাড়ী দুর্গাপুজোর আমেজ। তবে পুজোর আমেজ এখন আর আগের মতো না থাকলেও পুজোর ক্ষেত্রে আজও মেনে চলা হয় প্রাচীন বহু নিয়ম কানুন। পুজোর সূচনাকাল থেকেই চলে আসছে প্রতিপদ থেকে রাজবাড়ীতে পুজো শুরু হওয়ার প্রথা যা আজও হয়ে আসছে এখানে।
প্রথমা থেকে দশমী পর্যন্ত প্রত্যেকদিনই রাজবাড়ীতে থাকে দেবীর ভোগ রান্নার আয়োজন। ষষ্ঠীতে ছয় মন চালের ভোগ, সপ্তমীতে আট মন চালের ভোগ, অষ্টমীতে আট মন চালের ভোগ এভাবেই তিথি মেনে রাজবাড়ীতে এককালে চলতো ভোগ রান্নার আয়োজন। কিন্তু আজ জৌলুস হারিয়ে ভোগের চালের পরিমাণ কমলেও তা আজ প্রথা মেনেই হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন: এই রাজবাড়ির পুজোতে ভক্তদের কাঁধে চেপে দেবী যান
পুজোর কয়েকটা দিন কোনও রকম ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ এই বার্তা সকলকে দেওয়ার জন্য রাজ পরিবারের সমস্ত তলোয়ার, অস্ত্রশস্ত্র রাখা হয় দেবীর পায়ের তলায়। এছাড়াও পুজোর দিনগুলো সাংস্কৃতিক বিনোদনের জন্য থাকত বিশেষ শাস্ত্রীয় সংগীত, যাত্রাপালা গান প্রভৃতির ব্যবস্থা। কিন্তু আজ তা সেভাবে না হলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্থানীয় শিল্পী সমন্বয়ে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর। অষ্টমীতে সন্ধিপুজোর জন্য রাজবাড়ীতে সুদূর কেদারনাথ, বদ্রিনাথ থেকে আসতো ১০৮ টি নীল পদ্ম। কিন্তু এই নিয়ম আজ আর তেমনভাবে পালন করা হয় না। একসময় মহাষ্টমীর দিন দেবীর সন্ধীপুজোর সময় রাজ্যবাসীকে জানান দেওয়ার জন্য পুজো শুরু হওয়ার সময় রাজবাড়ির কামান দাগা হত এবং শেষেও দাগা হত কামান। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে প্রশাসনের তরফ থেকে শব্দ বিধি জারি করার ফলে উঠে যায় এই কামান দাগার প্রথা। এর পরিবর্তে চলে পটকা ফাটানো।
পুজো আসলে আজও রাজবাড়ির দুর্গা মন্ডপে পড়ে রঙের প্রলেপ। নানা রঙে সেজে ওঠে আটচালার এই দুর্গা মন্ডপ। প্রায় দু’মাস ধরে চলে রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা তৈরির কাজও। হলুদ বর্ণের প্রতিমা, ঢাকের সাজে গহনা আজও সেজে ওঠেন দেবী। মহিষাদলের গোপালপুর গ্রামের ভূঁইয়া পরিবারের মৃৎশিল্পীরা প্রায় ৬০ বছর ধরে প্রতিমা তৈরি করে এসেছেন। রাজবাড়ির মৃৎশিল্পী গৌর চন্দ্র ভূঁইয়া জানান, “আমার পরিবার ৬০ বছর ধরে রাজবাড়ির প্রতিমা তৈরি করে আসছে। একচালার পটল চেরা চোখের প্রতিমা এখনো হয়ে আসছে।”
অন্য খবর দেখুন