প্রীতম বিশ্বাস: আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনীভিত্তিক তথ্যচিত্র। পরিচালনায় উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। দেবব্রতর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন আগে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন উৎপলেন্দু। দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনের উপর নানা লেখা, নাটক, তথ্যচিত্র, এইসবের মধ্যেই এক অন্যরকম জায়গা করে নেয় উৎপলেন্দুর এই কাজটি।
তথ্যচিত্র দিয়েই ধ্বনি ও আলো-নির্ভর মাধ্যমে উৎপলেন্দুর হাত পাকানোর শুরু। নিজে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাই তাঁর প্রথম তথ্যচিত্র জেলবন্দি রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়ে। নাম মুক্তি চাই। নিজের সব কাজেই সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য। মিউজিক অফ সত্যজিৎ রে- এই তথ্যচিত্রটি উৎপলেন্দুকে জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতিও দেয়।
এবার আসা যাক চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় শুরুর দিন থেকেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রসঙ্গে। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ থেকে যে সমস্ত নতুন পরিচালক ভারত জুড়ে উঠে আসে তাদের প্রথম সারিতেই ছিলেন উৎপলেন্দু। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলেন্দু নিজে সে সময় বাংলায় পরিচিত নাম হয়ে উঠতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন: চিরতরে চোখ বুঝলেন ‘চোখ’-এর স্রষ্টা, রেখে গেলেন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট!
চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের কথায়, এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্রকার উঠে এসেছিলেন। তিনি নিজে এবং উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ছাড়াও অন্যতম একটি প্রধান নাম বিপ্লব রায়চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, এই তিনজনই পেয়েছিলেন জাতীয় স্বর্ণকমল পুরস্কার। ১৯৮০ সালে এই পুরস্কার পায় বিপ্লব রায়চৌধুরীর ‘শোধ’, ১৯৮২ সালে গৌতম ঘোষের ‘দখল’ এবং ১৯৮৩ সালে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, যে বছর চোখ পায় প্রথম পুরস্কার, সে বছর মৃণাল সেনের খারিজকে দ্বিতীয় পুরস্কার অর্থাৎ রজতকমলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ‘চোখ’ বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ওসিআইসি পুরস্কারেও সম্মানিত হয়। সারা ভারতের চলচ্চিত্র জগৎ নতুন করে চোখ মেলে এ বাংলার দিকে। নতুন সম্ভাবনার দিকে।
উৎপলেন্দুর প্রথম ছবি ‘ময়নাতদন্ত’ বন্ডেড লেবারদের সমস্যার কথা যেমন একদিকে তুলে ধরে অন্যদিকে তেমনি স্মিতা পাতিল অভিনীত ‘দেবশিশু’ তুলে ধরে ছড়িয়ে থাকা নানা সামাজিক কুসংস্কারের দিকেই। আগেই লিখেছি সঙ্গীতে বিশেষ দখল ছিল উৎপলেন্দুর, তারই প্রমাণ আমরা পাই ‘ছন্দনীড়’ ছবিটিতে।
নানা সামাজিক সমস্যা নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন যিনি, এমনকী যাঁর ছবি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ওসিআইসি পুরস্কার পায়, পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। সরে যান ছবি তৈরির দুনিয়া থেকেও।
সাংবাদিক অনিরুদ্ধ ধরের কাছ থেকে জানা গেল, উৎপলেন্দুর প্রথম দিনের শুটিং শেষে দেখা গেল সব দৃশ্যই তোলা হয়েছে আলোর উল্টো দিকে। ফলে কোনও দৃশ্যই ব্যবহারযোগ্য নয়। জীবনের শেষ দুই দশক আলোর উল্টো দিকেই থাকলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান উৎপলেন্দু চক্রবর্তী।
অনেক লাইট… ক্যামেরা… অ্যাকশন… বলার আগেই সময় বলে দিল কাট।