মহারাষ্ট্র বিধানসভার নির্বাচনের আগাম ফলাফল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রবল হারের পরেই। বিজেপি হেরেছে, শিন্ডে শিবসেনা হেরেছে আর সাফ হয়ে গিয়েছিল এনসিপি ভাইপো, এনসিপি অজিত পওয়ার গ্রুপ। সেই ভোটের হিসেব অনুযায়ী মহারাষ্ট্র অনায়াসে এসে যাওয়ার কথা ছিল মহাবিকাশ আগাড়ির হাতে, মানে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, কংগ্রেস আর শরদ পওয়ারের এনসিপি-র হাতে। কিন্তু যত দিন গেছে তত চরিত্র বদলেছে, ন্যারেটিভ বদলেছে, বদলেছে পার্সেপশন। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে মহারাষ্ট্রের নির্বাচন এক কনোনড্রাম, এক বিরাট জটিল ধাঁধা। মনে হচ্ছিল ২৮৮টা আসনের মধ্যে ১৮০টা পেয়ে যাবে মহাবিকাশ আগাড়ি বা এমভিএ, মুখ্যমন্ত্রী হবেন উদ্ধব ঠাকরে, কিন্তু তারপরে ভারত মহাসাগরের উপকূলে নানান খেলা হয়েছে। সেবারে মানে গত লোকসভার সময়ে আমরা দেখেছিলাম প্রবলভাবে মুসলিম ভোট গিয়ে পড়েছে মহাবিকাশ আগাড়ির পক্ষে। শিবসেনা শিন্ডের খোদ মুম্বইতেই পা নড়বড় করছিল। কিন্তু মাস ছয় আট আগে থেকে এক বিষাক্ত কমিউনাল প্রচার সেখানে শুরু হয়েছে, উঠে এসেছে স্লোগান বটেঙ্গে তো কটেঙ্গে, আলাদা আলাদা থাকলে আমাদের কেটে ফেলবে, এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়, আসুন আমরা একসঙ্গে থাকি। এসে গেছে রাজাকার। এসব স্লোগান হিন্দু ভোট কনসলিডেশনের জন্য। হবে? জানা নেই, কিন্তু এই স্লোগান পপুলার হয়েছে, কারা দিচ্ছেন? কেন? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমাদের প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে ওখানেও চালু হয়ে গেছে লাডলি বহনা স্কিম। ২০০০ করে টাকা দেওয়া হবে আমাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের মতো। একটা সময়ে মনে হচ্ছিল কাঁটে কি টক্কর চলছে। কিন্তু আবার কিছুদিন পরে এখন আবার ছবি বদলাচ্ছে।
মূলত দুটো জায়গা থেকে এই বদল আসছে। বিজেপি যে প্রবল মুসলমান বিরোধী প্রচারে নেমেছে, তার সঙ্গে একমত নয় অজিত পাওয়ার বা একনাথ শিন্ডে। রাজ ঠাকরের নবনির্মাণ সেনা প্রথমে খানিক আগ বাড়িয়েই ওই শিন্ডে অজিত বিজেপির মহাযুতিকে এগিয়ে রাখছিল, হঠাৎই তারা পিছিয়ে গেছে। খোদ মুম্বইতে রাজ ঠাকরের ছেলে অমিত ঠাকরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে শিন্ডে শিবসেনা। রাজ্যের বহু অংশে বিশেষ করে পশ্চিম মহারাষ্ট্রে কৃষকরা ভীষণ ক্ষুব্ধ, তারা তুলো, আখ, সয়াবিন, পেঁয়াজের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বাড়াতে বলেছিল, বাড়ানো হয়নি। বিরাট এই ক্ষোভ গত লোকসভাতে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল, এবারেও তার অন্যথা হবে না। আমি বরং মহারাষ্ট্রের এলাকাগুলো ধরে আমাদের অ্যাসেসমেন্টটা জানাই। মহারাষ্ট্রে ৬টা ভৌগোলিক রাজনৈতিক জোন আছে। প্রথমটা হল বিদর্ভ, আরএসএস-এর নাগপুরও এখানে আছে আবার নকশালদের গড়চিড়ৌলিও এই এলাকার মধ্যেই আছে, আছে অমরাবতী, অকোলা, গোন্ডিয়া, ওয়ার্ধা ইত্যাদি জেলাগুলো। মোট ৬২টা আসন আছে। বিরাট অংশ না খেতে পাওয়া গরিব, অন্য অংশে কৃষি, কমলালেবু আর তুলো হয়। এখানেই কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সবথেকে বেশি। এই ৬২টা আসনে মহাবিকাশ আগাড়ি এগিয়ে ৩৫-৪০টা আসনে, মহাযুতি ২২টা আসনে। এই এলাকাতে লোকসভার ভোটও কমবেশি এইরকমই ছিল। এই অঞ্চলে কংগ্রেস শিবসেনা দুই গোষ্ঠী আর বিজেপির সংগঠন আছে, শিবসেনার উদ্ধব গোষ্ঠীই এখানে শিন্ডের থেকে শক্তিশালী। এরপরের এলাকা পশ্চিম মহারাষ্ট্র, সুগার বেল্ট, শরদ পাওয়ারের গড় বলা যায়, কংগ্রেসের সংগঠনও আছে, বিজেপিও আছে। এখানে ৭০টা আসন আছে কিন্তু গত লোকসভাতে শরদ পওয়ার কামাল করেছিলেন, এবারে তার খুব বিরাট ফেরবদল হবে না, মহাবিকাশ আগাড়ি কমবেশি ৪০টা আর মহাযুতি ২৬টা আসন পেতে পারে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি ঘুমোচ্ছেন, আবার মণিপুর জ্বলছে
মারাঠওয়াড়া অঞ্চল, এটা হল অওরঙ্গাবাদ, বিড, হিঙ্গোলি, জালনা, লাতুর, যেখানে ভূমিকম্প হয়েছিল, নানদেদ ইত্যাদি জেলাগুলো। এই অঞ্চলের ৭৮ শতাংশ মারাঠি, ১৫ শতাংশ মুসলমান এই এলাকাতে থাকেন আর গত লোকসভার নির্বাচনের মতোই এবারেও মারাঠা ভোট মহাবিকাশ আগাড়ির দিকে, মারাঠা মানুষের সংরক্ষণের ইস্যু নিয়ে তারা এই সরকার এবং বিজেপির উপরে ক্ষুব্ধ। এখানেও ওই খরা আর চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে লাগাতার। কর্নাটক আর তেলঙ্গানার লাগোয়া এই অঞ্চলে কংগ্রেসের প্রভাব আছে, শিবসেনার দুটো গোষ্ঠীই আছে কিন্তু উদ্ধবের সংগঠন ভালো, গতবারের লোকসভার ফল তাই বলছে। এখানে ৪৬টা আসন আছে, আমাদের হিসেবে ২৭–৩১টা আসন পাবে মহাবিকাশ আগাড়ি আর ২০টা যেতে পারে ওই মহাযুতি জোটের কাছে। গত লোকসভার থেকে যে অঞ্চলে ফল অনেকটাই বদলাবে তা হল কোঙ্কন এলাকা, মানে ভারত মহাসাগর লাগোয়া সমুদ্র কূলবর্তী এলাকা, লোকসভাতে এখানে খুব ভালো ফল করেছিল এমভিএ কিন্তু এবারে ওখানে শিন্ডে শিবসেনার প্রচার, প্রার্থী সবটাই ভালো, দক্ষিণ কোঙ্কনে তবু এমভিএ খানিক এগিয়ে। এখানে মোট ৩৯টা আসনের মধ্যে মাত্র ১৪-১৫টাতেই থামতে হবে এমভিএ-কে, মহাযুতি জোট পেতে পারে ২৪টা আসন। রইল বাকি উত্তর মহারাষ্ট্র, নাসিক, ধুলে, জলগাঁও, ইত্যাদি জেলা জুড়ে ৩৫টা আসনে নির্বাচন, আর এখানে কাঁটে কা টক্কর। প্রায় আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে দুই শিবির। ১৭টা এমভিএ পেলে ১৮টা পাবে মহাযুতি, আবার উল্টোটাও হতেই পারে। মানে সমান সমান। সব মিলিয়ে আমাদের হিসেব মতো ২৮৮টা আসনের বিধানসভাতে মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি ১৫০-১৫৫টা আসন পেয়ে এগিয়ে থাকতে পারে, অন্যদিকে মহাযুতি পেতে পারে ১২৫। এটা এখনকার হিসেব, এখনও ৬ দিন প্রচার বাকি, রাহুল গান্ধী তাঁর প্রচার শুরু করেছেন, গতবারে উত্তর মহারাষ্ট্রে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সভাতে বাঁধভাঙা ভিড় হয়েছিল, এবারে প্রিয়াঙ্কা নিজের আসন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবারে তিনিও নামছেন। এই শেষ ছ’দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এবারে নির্বাচনে একটা লড়াই হচ্ছে যা মানুষের চোখের সামনে দুই শিবিরের লড়াই, দুই শিবির মানে বিজেপি, শিন্ডে শিবসেনা, অজিত পওয়ারের এনসিপি। অন্যদিকে কংগ্রেস, উদ্ধব শিবসেনা, শরদ পওয়ারের এনসিপি। অন্যদিকে রেওড়ি বিতরণ নিয়ে, বিভিন্ন ভাতা আর সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচুর বাওয়াল করে বিজেপি, সেই বিজেপি কেন, ওই মহাযুতির প্রত্যেক নেতার মুখে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, লাডলি বহনা প্রকল্পের কথা শোনা যাচ্ছে। হিন্দু ভোট কনসলিডেশনের জন্য নোংরা কমিউনাল প্রচার শুরু হয়েছে বিজেপির নেতৃত্বে, তাদের লক্ষ্য হিন্দু আসনের সিংহভাগ। ১১ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত এই রাজ্যের ৩০টা আসনে মুসলিম ভোট নির্ধারণ করে জয় পরাজয়, বিজেপি সেই সব আসনগুলো বাদ দিয়েই ক্যালকুলেশন চালাচ্ছে। যদি এর ফলে হিন্দু অধ্যুষিত আসনে কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু এতে ক্ষতি এনসিপি অজিত পাওয়ার কিংবা শিন্ডে শিবসেনার। অন্যদিকে তুলো, আখ, সয়াবিন আর পেঁয়াজের সাপোর্ট প্রাইস নিয়ে কৃষকরা ক্ষুব্ধ যা হয়ে উঠেছে নির্বাচনী ইস্যু।
প্রায় ৪০টা আসনে কাঁটে কি টক্কর, আর এই আসনের সিংহভাগ যাদের দিকে যাবে তারাই ক্ষমতায় আসবে, এখনও পর্যন্ত এই আসনের বেশিরভাগটাই যাচ্ছে এমভিএ-র দিকে। তাদের দুর্বলতা নিজেদের মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাব, যদিও কংগ্রেস শেষমেশ প্রচুর কম আসন, মাত্র ১০২ আসনেই সন্তুষ্ট থেকেছে কিন্তু এটা তো মানুষের সামনে ভোটের কথা। পিছনে আরও ইন্টারেস্টিং রাজনীতি চলছে, মূল ৬টা দলই কিন্তু অন্য ৫ জনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। শিন্ডে শিবসেনা জানে বিজেপি ৮০-৯০টা আসন পেলে আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া হবে না, অজিত পওয়ার জানেন তাকে শিন্ডেকে টপকাতে হবে, বিজেপি জানে তাদের এগিয়ে থাকতে হবে। কংগ্রেসের মাথায় আছে মুখ্যমন্ত্রী পদ, ৭৫-৮০টা আসন পেলে তারা হাত বাড়াবে ওদিকে ৯৬টা আসনে লড়ছে উদ্ধবের দল, তারাও জানে ৬৫-৭০টা পেতে হবে মুখ্যমন্ত্রী হতে গেলে। শরদ পওয়ার জানেন সুপ্রিয়াকে ক্ষমতার চূড়াতে বসানোর এরপরে আর সময় নেই তাঁর কাছে, তিনি চান ৮০টা আসনে লড়ে ৫৫-৬০টা আসন। তারপর যে কোনও ধারে যেতে পারেন, দুই এনসিপি এক হয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকার সম্ভব, আর এই সব খেলা কিন্তু লাগাতার চলছে। পরতে পরতে বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে সব্বার জন্য। ওই ২৩ তারিখেই সব সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে, ফলাফল আসতেই পারে, ক্ষমতা কার হাতে তা বুঝতে আরও দিন ১০-১৫ কেটে যাবে।