হ্যারো: লন্ডনের হ্যারোর(Harrow,London) এক অচেনা ঘরে শরতের দুপুরে কয়েকজন স্বপ্নবাজ বাঙালি মিলেছিলেন। সালটা ছিল ২০০৬ । উদ্দেশ্য একটাই—দেশ থেকে বহু দূরে থেকেও যেন ভারতীয় সংস্কৃতির স্পন্দন জাগ্রত থাকে, সন্তানরা যেন ‘আপন ঘর’-এর আলো-ছায়া ভুলে না যায়। সেই দিনই জন্ম নিল ‘পঞ্চমুখী'(Panchamukhi)। নামের ভেতর যেমন বহুমুখী ভাবনার ইঙ্গিত, তেমনি কাজের মধ্যেও ছিল ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিলন। ছোট্ট পরিসরে কঞ্চ -এর ধ্বনি, ঢাকের বাজনা আর ধূপ-ধুনোর গন্ধে শুরু হওয়া এই পথচলা, আজ বিশ বছর পার করে দাঁড়িয়েছে এক সাংস্কৃতিক দিগন্তের রূপে।
আরও পড়ুন:ডোনা গাঙ্গুলি ‘দশভুজা’ রূপে মঞ্চ মাতালেন
লন্ডনের বহুজাতিক পরিবেশে পঞ্চমুখী আঁকল ভারতীয় রঙের ক্যানভাস। হারো থেকে শুরু হলেও এর প্রতিধ্বনি পৌঁছে গেছে লন্ডনের সর্বত্র, এমনকি সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে। ভারতীয় কিংবা অ-ভারতীয়—সবাইকে টেনে এনেছে এই আবাহন, যারা খুঁজেছেন এক ফোঁটা দেশ, এক টুকরো ঘর, এক চুমুক নস্টালজিয়া।
‘পঞ্চমুখী’র প্রাণকেন্দ্র নিঃসন্দেহে দুর্গোৎসব(Durgotsav)। প্রতিটি বছর পূজার দিনগুলো যেন কবিতার মতো ভেসে ওঠে—মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি যেন গঙ্গার ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, পুরোহিতের কণ্ঠে উচ্চারিত সংস্কৃত শ্লোক মিশে যায় ঢাকের তালে। সকলে মিলে পুষ্পাঞ্জলি দেয়, ছোটরা মহড়া দিয়ে সাজিয়ে তোলে নৃত্য-গীতি, মায়েরা ভোগ রান্না করেন ভালোবাসায়, আর প্রবীণদের চোখে জল টলমল করে ওঠে দেবীর আগমনে। পঞ্চমুখীর পূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আসলে নস্টালজিয়া, বিশ্বাস আর পরিচয়ের পুনরুজ্জীবন।
কিন্তু শুধু পূজার আচারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই সংগঠন। বছর বছর নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পঞ্চমুখী প্রমাণ করেছে, ঐতিহ্য মানে তালপাতার খাতা নয়, বরং তা প্রবাহমান নদী, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায় সুর, নৃত্য আর শিল্পের ধারা। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন সেই ধারার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারতের খ্যাতনামা শিল্পী থেকে ব্রিটিশ-ভারতীয় তরুণ প্রতিভা—সবাই এক মঞ্চে, একসাথে গানে, নাচে, নাটকে মিলিত হন। যেন সীমান্ত মুছে যায়, কেবল বাঙালিয়ানা আর ইন্ডিয়াননেসই বেজে ওঠে।
পঞ্চমুখীর দুই দশকের পথচলায় সমাজসেবাও বড় অংশ জুড়ে আছে। দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো, প্রান্তিকদের সহায়তা করা কিংবা নানা চ্যারিটি উদ্যোগ—এসবের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে, প্রকৃত পূজা কেবল দেবীর নয়, মানুষকেও সমান মর্যাদা দেওয়াই তার পরম অর্থ।
এই কাহিনি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে একনিষ্ঠ সমর্থকদের জন্য। যারা প্রথম দিন থেকে আজও পাশে আছেন, সময়, শ্রম আর ভালবাসা দিয়ে গড়েছেন এই প্রতিষ্ঠানকে। কর্পোরেট জগৎকেও প্রথমবারের মতো কমিউনিটি উদ্যোগে যুক্ত করেছে পঞ্চমুখী, তবু মাটির গন্ধ হারায়নি কোনোদিন।
আজ যখন বিশ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে পঞ্চমুখী, তখন মনে হয়—এটা কেবল একটি সংগঠন নয়। এটা এক অনুভূতি, এক পতাকা, যেখানে ভারতীয়তা গর্বের সঙ্গে উড়ে বেড়ায়। শঙ্খের ধ্বনি আর হাসির কোলাহল মিলেমিশে লন্ডনের বাতাসে ভেসে ওঠে—যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়, শিকড় থেকে উঠে আসা ঐতিহ্য দূর দেশে গিয়েও ম্লান হয় না, বরং নতুন আলোয় আরও ফুটে ওঠে।
দেখুন অন্য খবর: