লখনউ: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ বারও কি যোগী আদিত্যনাথকেই তুলে ধরা হবে? বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্বই এ নিয়ে ধন্দে পড়েছে। পদ্ম শিবিরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে খবর, যোগী আদিত্যনাথ নয়, ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনে কেশব প্রসাদ মৌর্যকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরবে পদ্মশিবির। খুব শিগগিরই কেশব প্রসাদ মৌর্যের নাম ঘোষণা করা হবে। সূত্র জানাচ্ছে, শুক্রবার অমিত শাহের সঙ্গে কেশব প্রসাদ মৌর্যের একান্তে বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকেই নাকি মৌর্যকে এমন একটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির যোগী উত্তরসূরি হিসেবে বিজেপি এতদিন যোগী আদিত্যনাথকেই তুলে ধরেছে। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই মনে করেন, যোগী আদিত্যনাথই মোদি-উত্তর প্রধানমন্ত্রী মুখ। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির জাতীয় সভাপতি অখিলেশ যাদব যোগীর বিরুদ্ধে সুর চড়ানোয়, দিল্লি থেকে পালটা জবাব দিয়েছিলেন অমিত শাহ। অখিলেশের দাবি ছিল, যোগী সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি— সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে গোবলয়। অখিলেশের অভিযোগের জবাবে যোগীর কটাক্ষ ছিল, ‘সমাজবাদী পার্টির নেতা কোথা থেকে চশমা কিনেছেন, আমি তা জানতে চাই। টিভিতে যোগী সরকারের বিরুদ্ধে অখিলেশের অভিযোগ শুনছিলাম। ওনার রাজত্বে কী হয়েছিল এবং যোগীশাসনে কী হয়েছে, সে সমস্ত তথ্যই আমার কাছে আছে। উনি তা ভালো করে খতিয়ে দেখুন।’ প্রশ্ন হল, যোগী আদিত্যনাথকে কিছু বললে যে অমিত শাহের গায়ে ফোস্কা পড়ে, তিনি কেন চাইছেন না যোগীই মুখ্যমন্ত্রী থাকুন?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের একাধিক কারণ দেখছেন। গোবলয়ে যোগী আদিত্যনাথ বিরোধী একটি হাওয়া তৈরি হয়েছে। এটা বিরোধীদের দাবি শুধু নয়, পদ্মশিবিরও সেই হাওয়া টের পাচ্ছে। অখিলেশ যাদবের দাবি অনুযায়ী, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। তাঁর দাবি, ৪০০ আসন হাতছাড়া হবে বিজেপি-র। এতটা না-হলেও পদ্মশিবিরও কিন্তু বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, জনমানসে যোগীবিরোধী এই অসন্তোষ সামাল দিতেই কেশব প্রসাদ মৌর্যকে সামনে আনা হচ্ছে।
এই কেশবকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রজেক্ট করার পিছনেও দুটো কারণ দেখতে পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল। কেশবকে সামনে এনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যদি হারে, সে ক্ষেত্রে যোগী আদিত্যনাথের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রক্ষা হবে। পরাজয়ের দায়ভার কিছুটা গিয়ে পড়বে নরেন্দ্র মোদির ওপর। বলা হবে, মোদি ক্যারিশমা কাজ করেনি।
দ্বিতীয়ত, কেশব মৌর্য বিজেপির জন্য ফাটকাও হতে পারেন। যোগী আদিত্যনাথকে সরালে ভোটবাক্সে এ্রর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন রাজ্য বিজেপি-র নেতারা। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মুখ হিসেবে যোগীকে চাইছেন না। সে ক্ষেত্রে যোগীবিরোধী হাওয়া ঘুরে বিজেপির পালে হাওয়া লাগতে পারে।
বিজেপিও এটাই চাইছে। কারণ, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির কাছে উত্তরপ্রদেশ ভোট অ্যাসিড টেস্ট। বিধানসভা নির্বাচনে গোবলয়ে ধাক্কা খেলে, তার প্রভাব আগামী লোকসভা নির্বাচনেও যে পড়বে, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বেরও তা অজানা নয়।
প্রশ্ন হল, যোগী আদিত্যনাথ বিরোধী এই চরম অসন্তোষ তৈরি হল কেন? তারও নানাবিধ কারণ দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। যোগী-জমানায় হাথরাসের মতো একাধিক ধর্ষণ-খুনের ঘটনা, মোদির এই উত্তরসূরিকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে। অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড করেও মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে তিনি ব্যর্থ।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুরভোট: রাজ্য পুলিস টিএমসি-র দলদাস, আধাসামরিক বাহিনীর দাবিতে অনড় শুভেন্দু
অতিমারির দু-বছরেও যোগীবিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। বলাই যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যোগী আদিত্যনাথের কুরসি টলিয়ে দিয়েছে। কোভিডে আক্রান্তদের চিকিত্সা ঠিকমতো হয়নি। অক্সিজেনের আকালে অনেক করোনা আক্রান্তকে চোখের সামনে শ্বাসকষ্টে ছটফট করে মরতে দেখেছেন স্বজনেরা। আবার রাজ্যের কোভিড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থাতেও আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কাছের মানুষের মৃত্যুর পরেও পরিবার কিন্তু স্বস্তি পায়নি। মৃতরা পাননি শেষ সম্মানটুকু। নদীর চড়ে কোনওমতে গণকবর দেওয়া সারিসারি লাশ– প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাটি সরে বেরিয়ে এসেছে। জায়গার সঙ্কুলান না-হওয়ায়, শ’য়ে শ’য়ে দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। বেওয়ারিশ লাশের মতো গঙ্গায় ভেসে বেড়িয়েছে। ব্রিজের ওপর থেকে কোভিডের মৃতদেহ ফেলার দৃশ্যও ব্যথিত করেছে গোবলয়ের মানুষকে। এরকম টুকরো টুকরো ঘটনায় ক্ষোভের বারুদ জমে রয়েছে জনমনে। রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা, ভোটবাক্সে তার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন-‘লাল টুপি মানে রেড অ্যালার্ট’, অখিলেশ যাদবদের আক্রমণ প্রধানমন্ত্রীর
সর্বোপরি লখিমপুর কাণ্ডে কৃষক মৃত্যুর ঘটনা। বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর ছেলের নাম জড়িয়ে পড়ে এই ঘটনায়। লখিমপুরের ঘটনা নিয়ে যোগীর নীরবতা উত্তরপ্রদেশের মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি। এই সম্মিলিত প্রভাবেই গোবলয়ের আকাশে নিম্নচাপ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই নিম্নচাপের জেরেই ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যেতে পারে বিজেপি।
তার পরেও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। এতকিছুর পরেও যদিও বিজেপি জিতে যায়, সে ক্ষেত্রে যোগীর ভূমিকা কী হবে? তখন মৌর্যকে সরিয়ে ফের যোগীই কি মুখ্যমন্ত্রী? নাকি যোগীকে সে ক্ষেত্রে অন্য দায়িত্ব দেবে দল? মোদির উত্তরসূরি হিসেবে ২০২৩-এ লোকসভায় তাঁকে প্রার্থী করা হবে? লাখ টাকার প্রশ্ন।