কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: গত সোমবার কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের উদ্বোধনী ভাষণে দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দাবি করেছেন, এবারের চিন্তন শিবির আগের মতো গতানুগতিক হবে না। এই শিবির হবে ব্যতিক্রমী। এখান থেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দলকে পুনরুজ্জীবিত করার শপথ নেওয়া হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে।
খুব ভালো কথা। কংগ্রেস সভানেত্রীর এই উদ্বোধনী ভাষণে হয়ত অনেক কংগ্রেস নেতা, কর্মী উজ্জীবিত হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্নটা হল, সোনিয়া গান্ধী যা যা বলেছেন, সেগুলি করবে কে? মনে পড়ে গেল শরৎচন্দ্রের সেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের পিসেমশাইয়ের কথা। বাড়ির উঠোনে অন্ধকারে ছিনাথ বহুরূপীর বাঘের সাজ দেখে পিসেমশাই চিৎকার করছিলেন, সড়কি লাও, বন্দুক লাও। লেখকের কটাক্ষ ছিল, লাও তো বটে। কিন্তু আনে কে?
এখানেও সেই প্রশ্ন, করতে তো হবে অনেক কিছুই। কিন্তু করবে কে?
শুক্রবার থেকে রাজস্থানের উদয়পুরে শুরু হচ্ছে কংগ্রেসের বহু প্রতীক্ষিত চিন্তন শিবির। সেখানে সারা দেশের চারশোরও বেশি প্রতিনিধি তিনদিন ধরে আলোচনা করবেন। কী করে দলকে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে চাঙ্গা করা যায়, তার উপায় খোঁজার চেষ্টা হবে। আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, মূলত ছটি বিষয়ের উপর এবার জোর দেওয়া হবে। তার জন্য ছটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতি কমিটির মাথায় বসানো হয়েছে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। তাঁদের নেতৃত্বে ছটি প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, দেশ জুড়ে বিজেপির মেরুকরণের চেষ্টা ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে উদয়পুরে।
কংগ্রেসের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, এই চিন্তন শিবিরের পর কাজের কাজ কিছু হবে কি? না সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই গা ভাসিয়ে চলবে দল? এই শতাব্দী প্রাচীন দলটির এখন খুবই জীর্ণ দশা। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছেন। তখন থেকে দলে কোনও স্থায়ী সভাপতি নেই। সোনিয়া গান্ধী অন্তর্বর্তী সভানেত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অসুস্থ শরীর নিয়ে। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন চেয়ে ২০২০ সালে প্রবীণ নেতাদের একাংশ সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি দিয়েছেন। ওই বিক্ষুব্ধ নেতারা জি২৩ গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত। তার পরেও দু বছর কাটতে চলেছে। বিক্ষুব্ধ নেতারা মাঝে মধ্যে একটু বেফাঁস কথা বলে ফেলেন দলের নেতৃত্ব এবং কাজকর্ম নিয়ে। তাকে ঘিরে দুএকদিন মিডিয়ায় একটু হই চই চলে। তারপর সব থেমে যায়। দলের প্রবীণ নেতাদের একাংশের অভিযোগ, রাহুল নেতৃত্বে না থাকলেও তিনিই এখনও পিছন থেকে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে সমস্ত কলকাঠি নাড়েন। তাঁরা খুব সঙ্গত কারণেই নির্বাচিত সভাপতি চেয়েছেন। অগাস্ট সেপ্টেম্বরে নাকি কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচন শেষে স্থায়ী সভাপতি ঠিক হবে। ততদিন ভাঙা শরীর নিয়ে সোনিয়াই এই ভাঙা দল চালিয়ে যাবেন।
আসলে কংগ্রেসের অনেকে নেতাই বুঝে গিয়েছেন, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মতো আংশিক সময়ের নেতাদের দিয়ে কাজ চলবে না। তাঁরা দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবেন। আর মাঝে মাঝে দেশে ফিরে বিজেপির বিরুদ্ধে লোক দেখানো আন্দোলন করবেন। এভাবে চলে না। রাহুল তো আবার রাস্তায় নেমে যুদ্ধের বদলে টুইট যুদ্ধে বেশি দড়। তাঁর প্রধান অনুগামী, দলের অন্যতম মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালাও তাই। সারাদিন তাঁর টুইট যুদ্ধ চলে বিজেপির বিরুদ্ধে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পর থেকে তিন বছর কেটে গিয়েছে। বিজেপির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করার মতো অনেক ইস্যু হাতের সামনে পেয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু কোনওটাকেই তাঁরা কাজে লাগাতে পারেননি। কোনও ঘটনা ঘটলে সেখানে ছুটে যাওয়া, দুদিন তা নিয়ে একটু হই চই করা। ব্যাস। এই পর্যন্তই। তারপরেই রাহুলবাবা উধাও। কোথায় গেলেন, কোথায় গেলেন, খোঁজ, খোঁজ খোঁজ। দেখা গেল, তিনি দেশেই নেই। তিনি নাকি বিদেশে গিয়েছেন ধ্যান করতে। এভাবে কোনও দল চলে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা যে ধরনের পরিশ্রম করতে পারেন, তার ধারে কাছে যাওয়ার মতো কোনও নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না কংগ্রেসে।
এমন একটা দল এই কংগ্রেস, যার ভিত্তিই হল গান্ধী পরিবার। দলের একাংশ মনে করে, গান্ধী পরিবারের খপ্পর থেকে বেরোতে না পারলে দলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
আবার সেই প্রশ্ন। লাও তো বটে। কিন্তু আনে কে? গান্ধী পরিবারের বাইরে আর কে আছেন, যিনি হাল ধরবেন? গান্ধী পরিবারের তিন সদস্য সেটা ভালো করেই বোঝেন। তাই সোনিয়া, রাহুল মাঝে মাঝে হুমকি দেন সব ছেড়ে দেব বলে। তারপর দল আবার তাঁদেরই নেতৃত্বে থাকার জন্য পায়ে ধরে।
আজকে সারা দেশের মধ্যে মাত্র দুটি রাজ্যে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায়। রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়। তাও দুই রাজ্যেই দলের মধ্যে তীব্র গোষ্ঠিবাজি রয়েছে। রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত আর উপমুখ্যমন্ত্রী সচিন পাইলটের মধ্যে কার্যত মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এছাড়া মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস অন্য দলের শরিক হিসেবে ক্ষমতায়। সম্প্রতি একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা ভোটে পরাজয় হয়েছে কংগ্রেসের। ভোট কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে গেলে কংগ্রেসকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। দলের খোলনলচে বদল করতে হবে। ১৯৭৭ সালে ভরাডুবির পর কেউ ভাবতে পারেনি যে, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেস আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটের আগে তিনি কার্যত একা সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রচার চালিয়েছেন। তার ফসল তিনি ঘরে তুলতে পেরেছিলেন। বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ইন্দিরা আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। ঠাকুমার কাছ থেকে নাতি রাহুলবাবা কিছু শিক্ষা নেবেন কি?
চোখের সামনে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কার্যত একার নেতৃত্বে তিনি বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের জগদ্দল পাথর সরিয়ে ফেলতে পেরেছেন। মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল দলে তিনিই শেষ কথা। মমতাও কঠোর পরিশ্রম করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে। এখনও করে চলেছেন।
দেখা যাক, চিন্তন শিবির থেকে কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র খুঁজে পায় কিনা। তবে একটা কথা কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, শুধু চিন্তন করে লাভ নেই। এখন চাই একশন। দলের নিচুতলার কর্মীরাও সেটাই চান। আর শিবিরে বসে আলোচনা নয়, রাস্তায় নামতে হবে গোটা দলটাকে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট বড় চ্যালেঞ্জ কংগ্রেসের সামনে।