কেমন আছেন অধ্যাপিকা সোমা সেন? কেমন আছেন সুধা ভরদ্বাজ? কেমন আছেন গৌতম নওলাখা? নির্দিষ্টভাবে জানা নেই কারও। এটুকু জানা আছে, এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সকলেই জেলবন্দি প্রায় চার বছর ধরে। প্রবীণ কবি এবং সমাজকর্মী ভারভারা রাও অসুস্থতার কারণে জামিন পেয়েছেন বটে। কিন্তু আপাতত তাঁকে মুম্বই ছাড়তে বারণ করা হয়েছে।
এই সমাজকর্মী তথা বিশিষ্টরা নাকি দেশদ্রোহী। তাঁরা রাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক থ্রেট। ২০১৮ সালে ভীমা করেগাঁওতে ওই প্রবীণরা নাকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তখন থেকে তাঁরা জেলবন্দি। অনেকের একাধিকবার জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। অনেকের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার। তাঁদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মাথা ব্যথা নেই। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও এই সমাজকর্মীদের নিয়ে খুব একটা মুখ খুলতে দেখা যায় না।
আসলে এই সমাজকর্মীরা বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের তীব্র বিরোধী। তাঁরা দলিত ও আদিবাসী অধিকার নিয়ে অনেকদিন ধরে আন্দোলন করছেন। সেই সূত্রেই ভীমা করেগাঁও মামলায় ২০১৮ সালে তাঁদের ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই থেকে তাঁরা জেলে পচছেন। এই বিশিষ্টদের মধ্যে অধিকাংশই বৃদ্ধ। নানান রোগের শিকার। তবু বারবার তাঁদের জামিন বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এমনই আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা। ভারভারা রাও এই মুহূর্তে জামিনে থাকলেও ১৬ বছর আগের একটি মাওবাদী হামলার ঘটনা সংক্রান্ত মামলা খুঁচিয়ে বার করেছে বিজেপি শাসিত কর্ণাটক সরকার। মধুগিরির দায়রা আদালত প্রবীণ কবির বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এমনিতেই ভারভারার পরিবার অসুস্থ এই বৃদ্ধকে নিয়ে জেরবার। ৮১ বছর বয়সে কী বিড়ম্বনাই না সইতে হচ্ছে তাঁকে।
আরও পড়ুন : ফ্ল্যাশ ব্যাক
ভীমা করেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত আর এক প্রবীণ সমাজকর্মী গৌতম নওলাখার সঙ্গে আবার মহারাষ্ট্রের তালোজা জেল কর্তৃপক্ষ খারাপ ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর সঙ্গী শাহবা হোসেন। অভিযোগ উঠেছে, এইভাবে মানসিক দিক দিয়ে গৌতমকে কমজোরি করে দেওয়া হচ্ছে।
মনে পড়ছে এই মামলাতেই জড়িয়ে মৃত আদিবাসী সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীর কথা। স্ট্যান আদিবাসী ও দলিতদের নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছিলেন। তাঁকেও বিজেপি সরকার ভীমা করেগাঁও মামলায় ফাঁসিয়েছিল। ফাদারের মৃত্যু অত্যন্ত মর্মান্তিক। জেলে থাকতে থাকতে তিনি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। একাধিকবার তাঁরও জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরকমই তাঁর জামিন মামলার শুনানি ছিল একদিন। আদালতে শুনানি শুরু হতে স্ট্যান স্বামীর আইনজীবী এজলাসে দাঁড়িয়ে বলেন, মাননীয় বিচারক, এই মামলার শুনানির আর প্রয়োজন নেই। কারণ আমার মক্কেল আজ সকালেই মারা গিয়েছেন। মুহূর্তের জন্য গোটা আদালত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এর পরেও কেন্দ্রীয় সরকার বাহাদুরের কোনও চিত্ত চাঞ্চল্য হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এই মামলায় অনেকের বিরুদ্ধে আবার ইউএপিএ ধারাও দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ, এই বন্দিদের জামিন পাওয়া খুব শক্ত। সরকার চাইলে তাঁদের বছরের পর বছর জেলে রেখে দিতে পারে।
বিশিষ্ট এই সমাজকর্মীদের পরিবারগুলি আজ অসহায়। অধ্যাপিকা সোমা সেনও খুবই অসুস্থ। তাঁর কন্যা পাগলের মতো মায়ের জামিনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই অবস্থা অন্যদেরও। তবু অবিচল মহামান্য রাষ্ট্রশক্তি। বিশিষ্টদের একটাই অপরাধ, তাঁরা বিজেপির আদিবাসী ও দলিত বিরোধী মনোভাবের প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অতএব দাও তাঁদের ফাঁসিয়ে। বুঝুন, কত ধানে কত চাল!
কেমন আছেন সোমা সেন, গৌতম নওলাখা, সুধা ভরদ্বাজরা? কে জানে। কেউ হয়ত জেলের কুঠুরিতে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ হয়ত জেলের হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের সম্পর্কে পরিষ্কার করে কেউ কিছু জানতে পারছে না। সরকার কিছু জানাচ্ছেও না। তাঁদেরও হয়ত স্ট্যান স্বামীর মতো পরিণতি হবে।
কুর্নিশ আপনাদের। এই লড়াই জারি থাক।