ওড়িশা: আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে এখনও কালাজাদুর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় বেশ কিছু গ্রামে। এই কালাজাদুর প্রভাব কাটিয়ে কী ভাবে মানুষকে হাসপাতালমুখী করা যায়, সেই অসম্ভব কঠিন কাজটি রূপায়িত করে ফোর্বস ইন্ডিয়ার (Forbes India) প্রভাবশালী ভারতীয় মহিলাদের তালিকায় ঢুকে পড়লেন মাতিলদা কুল্লু (Matilda Kullu Asha Worker)। ভারতের কয়েক জন নামজাদা মহিলার পাশাপাশি ওড়িশার ৪৫ বছরের এই আদিবাসী মহিলাও নিজের জায়গাটি করে নিয়েছেন। আসুন, আলাপ করানো যাক মাতিলদা কুল্লুর সঙ্গে।
নামের আগে ‘আশাকর্মী’ জুড়লে মাতিলদা কুল্লুর সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। মাতিলদার নিরন্তর লড়াই আর পাঁচটা আশকর্মীর থেকে তাঁকে আলাদা করেছে। ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার বরাগাঁওয়ের গর্গাদবহল গ্রাম। এটাই কাজের জায়গা মাতিলদার। মধ্য চল্লিশের এই মহিলার সূত্রেই ওড়িশার এই অখ্যাত গ্রাম এখন প্রচারের আলোয়।
সামান্য শরীর খারাপ হলেও ওড়িশার এ গ্রামের কেউ হাসপাতাল বা গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেন না। হাসপাতাল তো দূর অস্ত, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে, এটাই তাঁরা মনে করতেন না। অসুখ-বিসুখ হলে তাঁরা ছুটতেন গ্রামের ওঝার কাছে। এটাই গর্গাদবহল গ্রামের দস্তুর। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করতেন, ওঝাই পারে কালাজাদু করে তাঁদের রোগমুক্ত করতে। গ্রামের সরল মানুষগুলির এই দুর্বলতার সুযোগে পসার বাড়ে ওঝাদের। আশাকর্মীর চাকরি নিয়ে ১৫ বছর আগে এই গ্রামে পৌঁছে বিস্মিত হন মাতিলদা। জানতেন কাজটা তাঁর সহজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে কুসংস্কারে অভ্যস্ত মানুষগুলিকে প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হলে, তাঁকে লড়াই করতে হবে। একদিনে তা হবে না। এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে।
হাসপাতালে যেতে নারাজ গ্রামবাসীদের তিনি যদি ডাক্তারে ভরসা রাখার পরামর্শ দেন, তাতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রথম প্রথম উপহাসের পাত্রী হয়ে ওঠেন মাতিলদা। তাঁকে দেখলে, তাঁর সামনেই বিদ্রুপ করতেন গ্রামবাসীরা। ফলে যে লড়াই তিনি মনে করেছিলেন, বাস্তবের লড়াইটা ছিল তার থেকেও কঠিনতর। তবে, দমে যাননি। চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: করোনাবিধি মেনেই চালু আইসিএসই দশম শ্রেণির পরীক্ষা
তাঁর এই দৃঢ়তাই ওড়িশার এই গ্রামের ছবিটা বিগত দেড় দশকে বদলে দিয়েছে। ধীরে ধীরে গর্গাদবহলের গ্রামবাসীরা কালাজাদুর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। মাতিলদা যদি এই গ্রামে না যেতেন, তা হলে আজও পিছিয়ে থাকত ওড়িশার গ্রামটি। এখানেই তাঁর সাফল্য। এখানেই একজন মহিলা হিসেবে তাঁর প্রভাব। যে প্রভাব তিনি বিস্তার করেছেন নিজের স্নেহ-ভালবাসা, নিষ্ঠা দিয়ে। যে কারণে ফোর্বস ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী মহিলাদের তালিকায় ওড়িশার এই আশাকর্মীর নামও জ্বলজ্বল করছে। মাতিলদার কথায়, ‘এই গ্রামের মানুষ অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে চাইতেন না। আমি যখন গ্রামবাসীদের হাসপাতালে যেতে বলতাম, তখন আমাকে নিয়ে ওরা মশকরা করত। আমার জাতপাত নিয়েও ওঁরা কটাক্ষ করেছেন। আমি তা গায়ে মাখিনি। ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে যাওয়াটা যে কতটা জরুরি, তা বোঝাতেই আমার অনেকগুলি বছর লেগে গিয়েছে।’
জানালেন, করোনা অতিমারির বাড়বাড়ন্তের সময় তাঁর দায়িত্ব বহু গুণে বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখতেন কার করোনার উপসর্গ রয়েছে। প্রতিদিন এমন অন্তত ৫০-৬০ জনকে তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠিয়েছেন কোভিড টেস্ট করাতে। করোনা নিয়ে মানুষের মনে যে ভুল ধারণা ছিল, তা দূর করতেও সময় লেগেছে তাঁর।
আর যদি পারিশ্রমিকের কথা বলেন? মাস বেতন ছিল ৪৫০০ টাকা। করোনার সময় সেই বেতন কাটছাঁট হয়ে ২০০০ টাকা হয়। কিন্তু বেতন কমলেও নিজের কাজে তিনি ফাঁকি দেননি। বেতন-অঙ্কের তোয়াক্কাও করেননি। মাতিলদার কথায়, ‘দীর্ঘ দেড় দশক ধরে এ গ্রামে কাজ করে মানুষগুলোর সঙ্গে এক আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখানে বেতনটা ফ্যাক্টর নয়।’