কলকাতা টিভি ওয়েবডেস্কঃ আগামী ৩০ অক্টোবর রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। পুজোর আমেজ কাটিয়ে জোড়কদমে শুরু হয়েছে ভোটের প্রচার। ঘটনাচক্রে সেই প্রচারের আবহে ঢুকে পড়েছে কুমিল্লাকাণ্ড। ঢুকে পড়েছে নয়, রীতিমতো পরিকল্পনা করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে টেনে আনা হয়েছে ভোটের ময়দানে। অনেকটা ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে হওয়া পুলওয়ামকাণ্ডের মতো।
আরও পড়ুন ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে মুখ খুললেন জয়া
কাশ্মীর উপত্যকার পুলওয়ামা সেক্টরে পাকজঙ্গি হামলায় চল্লিশজন ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। ওই ঘটনা একশো তিরিশ কোটি দেশবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যেহেতু পাকিস্তানের নাম জড়িত,তাই দেশপ্রেমের সঙ্গে হিন্দু ভাবাবেগ জেগে ওঠে পুলওয়ামা কাণ্ডের জেরে। পরিকল্পনা করে তা জাগিয়ে তোলা হয়েছিল। নির্দিষ্ট করে বলা চলে শাসক বিজেপি এবং এক শ্রেণীর সংবাদ মাধ্যম সেই ভাবাবেগ উস্কে দিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। সেই উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ারে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি জনমত ক্রমে ফিকে হতে থাকে। যার ফায়দা পায় বিজেপি। ফলত, তিন শতাধিক আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদির দল দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে। পুলওয়ামা কাণ্ড নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা রয়েই যায়। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যপাধ্যায়সহ প্রায় সব বিরোধী নেতৃত্ব ,পুলওয়ামাকাণ্ড নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কেননা ওই ঘটনা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আসরে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার তাদের ভোট প্রচারে যেভাবে ব্যবহার করেছিল ,তা এক কথায় বেনজির।
আরও পড়ুন দুর্যোগ কাটছে পাহাড়ে, স্বাভাবিক হচ্ছে যান চলাচল
সেবার ছিল হিন্দু দেশপ্রেমের আবেগ। এবার বাংলাদেশের কুমিল্লা কাণ্ডকেও সেই পুলওয়ামা মডেল হিসেবে কি বিজেপি বাঙলার
চার উপনির্বাচনের প্রচারে ব্যবহারের ছক কষছে ? অন্তত হাব ভাব দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। পুলওয়ামা উত্তর পর্বে সঙ্ঘপরিবার দেশ জুড়ে যেমন ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ে সক্রিয় হয়েছিল, বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরে হামলার ঘটনার পরপরই রাজ্যের বিজেপি নেতাদের বোল চাল দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। কুমিল্লাকাণ্ড যেন হাতে চাঁদ পাওয়া গিয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিজেই ঝোলা থেকে বিড়াল বের করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, কুমিল্লার ঘটনার পর বাংলার সনাতনীরা আসন্ন উপনির্বাচনে তাদের আরও বেশি বেশি করে সমর্থন করবে। অর্থাৎ কোনও লুকো চাপা নেই। প্রতিবেশী রাজ্যের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা পুঁজি করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন তাঁরা। প্রায় একই সুরে বাংলায় ধর্মীয় বিভাজন উস্কে দিতে কুমিল্লা,চট্টগ্রাম নোয়াখালীর ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছেন,রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন ও বর্তমান সভাপতি দিলীপ ঘোষ ,সুকান্ত মজুমদার। এপার বাংলার ঘরোয়া রাজনীতি,অর্থনীতি উন্নয়ন প্রসঙ্গ তাঁদের প্রচারে ব্রাত্য। আসন্ন উপ নির্বাচনে বাংলাদেশের ঘটনাকে শান দিয়ে চলেছে বিজেপি। বাংলার গেরুয়া নেতারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর উপর হামলার নিন্দার ছলে এপারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার পালে হওয়া দিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। তাঁদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে এমন একটা ঘটনার জন্য তাঁরা মুখিয়ে ছিলেন।
আরও পড়ুন নজরে বিধানসভা, কর্মীদের চাঙ্গা করতে বৃহস্পতিতে গোয়ায় নেত্রী মমতা
প্রসঙ্গত কোচবিহারের দিনহাটা আর নদিয়ার শান্তিপুর ,দুটোই বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। মাত্র বিশ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ। এখানে ধর্মীয় মেরুকরণের অনুকূল জমি বহুযুগ ধরে তৈরি করে চলেছে সঙ্ঘ পরিবার। এ বাংলায় হিন্দু ভাবাবেগ চাগিয়ে তুলে অন্তত দুটো বিধানসভায় ভোট বৈতরণী পার করার স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি নেতারা।
রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রে উপ নির্বাচন। রাজ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন। তার উপর চারটির মধ্যে যে দুটি নদিয়ার শান্তিপুর আর কোচবিহারের দিনহাটা। শান্তিপুরে জগন্নাথ সরকার ও দিনহাটা কেন্দ্রে নিশীথ প্রামানিক জিতেছিলেন। দুজনেই নিজেদের লোকসভার সদস্যপদ টিকিয়ে রাখতে বিধায়ক পদ ছেড়ে দিতে এই অকাল ভোট। স্বভাবতই, বিগত মে মাসের নির্বাচনী ফলাফলের অভিজ্ঞতার পর নিজেদের জেতা ওই দুটি আসন রক্ষা করা যে কী কঠিন তা ইতিমধ্যে মালুম পেয়ে গিয়েছে রাজ্য বিজেপি নেতারা। পাশাপাশি ভাঙনও শুরু হয়েছে গেরুয়া শিবিরে। জনপ্রতিনিধি থেকে মন্ডল স্তর, সর্বত্রই সেই সাংগঠনিক ভাঙনের গ্রাস।
আরও পড়ুন গৌরি লঙ্কেশ তদন্তে কোকা প্রত্যাহারের নির্দেশ বাতিল সুপ্রিম কোর্টের
এই প্রেক্ষাপটে উপ নির্বাচন, বিজেপি নেতৃত্বের কাছে গলার কাঁটা। প্রাথমিক ভাবে করোনার দোহাই দিয়ে তারা ভোট ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে সওয়াল করে। এই রাজনৈতিক তাই কেন্দ্র বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া, সেখানে ছয় মাস আগে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিল বিজেপি। স্বভাবতই তা ধরে রাখতে মরিয়া তারা।
অবশ্য গত মাসে হওয়া ভোটে তিনটি আসনেই বিজেপিকে গোহারা হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে তৃণমূল। এবার যে চারটি আসনে লড়াই সেখানে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও ইস্যু খুঁজে পায়নি প্রধান বিরোধী দল। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘটনায় উৎসাহিত গেরুয়া শিবির। দিনহাটা ও শান্তিপুরে তাই ধর্মীয় বিভাজন তাদের প্রধান লক্ষ্য। শুধু বিজেপি কর্মীদের উপর ভরসা নয়, সঙ্ঘ সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের কর্মীরা ওই দুই কেন্দ্রে ভোটারদের ঘরে ঘরে প্রচার করছে। আফগানিস্তানে তালিবান, কাশ্মীরে হিন্দুদের নিশানা করে বেড়ে চলা জঙ্গি আক্রমণ এবং সর্বশেষ কুমিল্লাসহ বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের সত্য-অর্ধ সত্য মেশানো আখ্যান ভোটারদের কাছে তুলে ধরাটাই তাদের প্রধান কাজ। এক সূত্রের দাবি, সরাসরি ভোট ভিক্ষা করছেন না এই স্বয়ংসেবকরা। রাজ্যে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে বাংলার হালও কুমিল্লার মতো হবে। এমন এক ‘আতঙ্কের’ পসরা নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরছে তাঁরা।
পেট্রোপণ্যের অপ্রতিরোধ্য মূল্য বৃদ্ধি থেকে কোভিডকালে বেড়ে চলা বেকারত্ব কিংবা বিজেপি শাসিত রাজ্যর আইন শৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষযের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার উন্নয়ন যখন তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার, তখন কুমিল্লাকাণ্ড আঁকড়ে ধরে ধর্মীয় ভাবাবেগ জাগিয়ে রাখাটাই বিজেপির অগ্রাধিকার।