কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক : তিনি কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করেন না। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে পছন্দ করেন না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে মৌনমোহন বলে কটাক্ষ করতেন তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা। তবে তিনিও অনেক বিষয়েই মৌন থাকিতে ভালোবাসেন। যেমন এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন নিয়ে তিনি প্রায় হিরন্ময় নীরবতা পালন করে চলেছেন। আন্দোলন শুরুর প্রথমে তবু দু’চারদিন কৃষকদের বিরুদ্ধে কিছু বলেছিলেন। বিরোধীদের চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি নীরবই।
উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছেলের গাড়িতে পিষে আট কৃষকের মৃত্যু হল। তা নিয়ে দেশ উত্তাল হল। কিন্তু লখিমপুরের ঘটনা নিয়ে তিনি নীরবই রইলেন। ঘটনার পরপরই তিনি লখনউ গেলেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে অমৃত মহোৎসব পালন করিতে। কিন্তু তাঁর মুখে লখিমপুরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি কথাও শোনা গেল না। ভাবখানা এমন ছিল তাঁর যেন লখিমপুরে কিছুই হয়নি।
আরও পড়ুন – আমি ভারতের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নিয়েছি: রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার সভাপতি
আবার এই তিনিই কিছু কিছু বিষয়ে বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন। মন কী বাত অনুষ্ঠানে তিনি বিস্তর কথা বলেন। সাংবাদিক সম্মেলন না করলেও তিনি সর্বদা প্রচারের আলোয় থাকতে ভালোবাসেন। বৃহস্পতিবার তাঁকে সেই প্রচারের আলোতেই থাকতে দেখা গেল দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। উপলক্ষ্য ছিল দেশে করোনার টিকাকরণ ১০০ কোটির মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলা। পরনে গলাবন্ধ পাঞ্জাবি, হাতে জড়ানো নকশা কাটা সাদা কাশ্মীরি শাল। টুইটে তিনি দেশবাসীকে অভিনন্দন জানালেন। বললেন, ইতিহাস রচনা করল ভারত। টিকাকরণে ১০০ কোটি ছুঁয়ে ফেলাকে ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকার আদিখ্যেতা কিছু কম করল না। দেশের সর্বত্র ট্রেনে, বিমানে কেন্দ্রীয় সরকারের সাফল্য প্রচার, দেশের বহু পর্যটনস্থল ও স্মৃতিসৌধ আলোয় সাজানো হল সন্ধ্যায়। লাল কেল্লায় তোলা হল জাতীয় পতাকা। দিল্লির বিজেপি অফিসে উৎসব পালিত হল। কোথাও কোথাও লাড্ডু বিলি হল। আর সর্বত্র এই সাফল্যের মূল হোতা হিসেবে তুলে ধরা হল তাঁকে। তাঁর জন্যই নাকি দেশে করোনার টিকাকরণে ১০০ কোটি ছুঁয়ে ফেলতে পারা গেল। স্তাবকরা ধন্য ধন্য করে উঠল।
আরও পড়ুন – ভারতের টিকাকরণ কর্মসূচি নিয়ে গোটা বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে: মোদি
বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার যখন এই উল্লাসে মত্ত, তখন বিরোধীদের অভিযোগ, এটা প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছাড়া কিছুই নয়। তাদের বক্তব্য, ১০০ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে মানে এই নয়, ১০০ কোটি মানুষ টিকা পেয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যার মাত্র ২১ শতাংশের টিকাকরণ হয়েছে। এক ডোজ টিকা মিলেছে ৭১.০৮ কোটি মানুষের, দুই ডোজ টিকা পেয়েছে ২৯.৫১ মানুষ। ৩২ কোটি মানুষ এক ডোজও টিকা পায়নি। ৪২ কোটি মানুষের দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাওয়া বাকি। বিরোধীদের আরও বক্তব্য, দেশের ৯৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে এই বছরের মধ্যে টিকা দেওয়া হবে বলে দাবি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তথ্য বলছে, টিকা পেয়েছে ২৯ কোটি মানুষ। এখনও বাকি ৬৫ কোটি। আর দু’মাস দশ দিনের মধ্যে এই ৬৫ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব? প্রশ্ন বিরোধীদের। তার মধ্যে ১৮ বছরের নীচে টিকা দেওয়ার কাজ এখনও শুরুই হয়নি। বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কিসের এত মাতামাতি?
করোনার টিকা সরবরাহ নিয়ে গত কয়েক মাসে বিতর্কও কম হয়নি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার সরবরাহ নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছে, প্রধানমন্ত্রীকে বারবার বিরোধী রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা চিঠি দিয়েছেন। টিকার দুই ডোজের ব্যবধান নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছে। কখনও ২৮ দিনের, কখনও ৮৪ দিনের ব্যবধানের কথা বলে আমজনতাকে বিপাকে ফেলা হয়েছে। টিকার অপ্রতুলতা নিয়েও লাইনে মারামারি, পুলিশের লাঠি, কত কী না হয়েছে। তারপরেও টিকাকরণে ১০০ কোটি ছুঁয়ে ফেলা নিয়ে উৎসব করা সাজে কি না, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন – নতুন দল গঠনের ঘোষণা অমরিন্দরের, বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়তে পারেন ভোটে
আসলে এটাই তাঁর স্টাইল। তাঁর কৌশল। শুধু চাই প্রচারের আলো। সাংবাদিক সম্মেলন করার দরকার নেই তার জন্য। সরকারি প্রচার ব্যবস্থাই যথেষ্ট। গত বছর করোনার সূচনা পর্বেই আমরা তার নিদর্শন দেখেছি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়ে তিনি দেশ জুড়ে লক ডাউন ঘোষণা করেছেন। হাজার হাজার মানুষকে তার জন্য কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরতে গিয়ে হয়রান হয়েছেন। রাজ্যে রাজ্যে হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখা গিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। পথে কত শ্রমিক মারা গিয়েছেন। কত শ্রমিককে পুলিশের হাতে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। তা নিয়েও।তিনি ছিলেন নীরব।
জাতির উদ্দেশে একাধিকবার ভাষণ দিয়েছেন তিনি। কখনও লক ডাউনের ঘোষণা করেছেন, কখনও প্রদীপ জ্বালাতে বা থালাবাটি বাজাতে বলেছেন। তাতেই নাকি করোনা দূর হয়ে যাবে। তাঁর অনুপ্রেরণায় বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা নানারকম কুসংস্কার ছড়িয়েছেন। কেউ বলেছেন, গোমূত্র, গোচনা পান করলে করোনা হবে না। যে যা পেরেছেন, উপায় বাতলে দিয়েছেন। তাতে মানুষ আরও বিভ্রান্ত হয়েছে। এবার মাতামাতি টিকার ১০০ কোটির মাইল ফলক ছোঁয়া নিয়ে। এই মাতামাতি যে ছলনা ছাড়া কিছুই নয়, তা দেশবাসী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। যত বুঝবে, ততই দেশের পক্ষে মঙ্গল।