নয়াদিল্লি : সবুজ, শ্যামল, সিক্ত আমাদের এই দেশে অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষ প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও সত্ত্বা নয়, বরং নিজেকে প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে গণ্য হয়েছে। তাই ভারতীয় সাহিত্য ও ধর্মকথায় বারবার ফিরে এসেছে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের কথা। ঋগ্বেদের নানা সূক্তে দেখা যায় প্রকৃতির অপার শক্তিকে অবলম্বন করেই মানুষ দেব-দেবীর রূপ কল্পনা করেছে। আবার ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’-এর চতুর্থ সর্গে শকুন্তলার দুষ্মন্তগৃহে যাত্রার যে ছবি কালিদাস এঁকেছিলেন সেখানে প্রকৃতিকেও শকুন্তলার বিরহে ভারাক্রান্ত হিসেবে আঁকা হয়েছিল। একদা এই পুণ্যভূমিতে সন্তানস্নেহেই বৃক্ষ থেকে শুরু করে প্রাণীকূল সকলেই লালিত হত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বনভূমির উপরে বারবার নেমে এসেছে আঘাত।
উনিশ শতকে শিল্পবিপ্লব ও নগরায়ণকে কেন্দ্র করেই এই বিরোধের শুরু। তৈরি হয়েছে একের পর এক নগর। মাথা তুলেছে শিল্পাঞ্চল। গাছ কেটে গড়ে উঠল বসতি। তখন থেকেই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে কোথাও যেন এক দুস্তর ব্যবধান রচিত হয়ে গেল। প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা সম্পদের ব্যবহার করতে গিয়ে একে একে বিপন্ন হতে থাকল আমাদের জঙ্গল, পশুপাখি, জঙ্গলের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতা— এক কথায় সব কিছুই। কিন্তু প্রাচীন ভারতের সেই তপোবনের ঐতিহ্যকে আজও মনে রেখেছেন কিছু মানুষ। তাঁদের চোখে তাই উন্নয়ন, পরিবেশের প্রতিস্পর্ধী নয় বরং পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন এক ব্যবস্থা যা মানব সমাজের সঙ্গে গোটা প্রাণীকূলকে বিকাশের পথ দেখাবে। তাই আলোচনায় বারবার ফিরে আসে ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কথা । প্রকৃতির উপরে যত বার মানুষের তৈরি করা আঘাত এসেছে তত বারই তার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন পরিবেশপ্রেমীরা। নিজেদের এগিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘‘আমাকে আঘাত কর কিন্তু প্রকৃতিকে নয়।’’ আজও সেই আন্দোলনের স্রোত অব্যাহত। এই প্রতিবাদ-আন্দোলনের তালিকায় অন্যতম ছত্তীসগড়ের হাসদেও অরণ্য বাঁচাও আন্দোলন ৷
মধ্য ভারতের ১,৭০,০০০ হেক্টর জুড়ে থাকা হাসদেও আরান্ড অরণ্যাঞ্চলে জীববৈচিত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য রাখার জন্য সুপরিচিত। উত্তর ছত্তীসগড়ের কোরবা, সারগুজা ও সুরজপুর জেলার মধ্যে এই অরণ্যাঞ্চল বিস্তৃত রয়েছে। এই অরণ্যাঞ্চলেই নজর পড়েছিল শাসকের। কয়লা উত্তোলনের অজুহাতে জঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কার্যত ‘বেচে’ দেয় সরকার। চিনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনার নিরিখে আত্মনির্ভর হওয়ার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় পণ্যের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। আর এই লক্ষ্যেই ৪০ টি নতুন কয়লা খনি তৈরিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আসলে, আত্মনির্ভর ভারত স্লোগানের মধ্যে দিয়ে আসলে আদিবাসী উচ্ছেদ করে, নির্বিচার সবুজ নিধনের মাধ্যমে ভূপ্রাকৃতিকভাবে ভারতের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অরণ্যভূমিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে মোদি সরকার।
প্রতিবাদ আদিবাসীদের৷
মোদির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পড়েছে ছত্তিসগড়ের হাসদেও আরান্ড বনাঞ্চলের প্রায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার একর জমিতে ৪ টি কোল ব্লক। প্রায় ৫ বিলিয়ন টন কয়লা ভাণ্ডারের উপর বসে থাকা হাসদেও আরান্ড জঙ্গলে খনি তৈরি করতে পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্রও পেয়েছে আদানি গোষ্ঠী। এই পদক্ষেপ অত্যন্ত স্পর্শকাতর । ভারতের কয়লা খনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেও এই ৪০ টি কয়লা খনির নিলাম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে খনির বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যকরণের একটি ধাপ তাতে কোনও সন্দেহ নেই । ২০১১ সালে ২ অক্টোবর ঘাটবারা গ্রামের বাসিন্দারা গ্রামসভা করে কয়লার জন্য বন খননের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করেছিলেন। ১০ বছর বাদে ২ অক্টোবর কয়েকশো গ্রামবাসী আন্দোলনে নামলেন তাঁদের দাবি পূরণের জন্য। ওপেন কাস্ট কোল মাইনিং থেকে জঙ্গলকে বাঁচানোর দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁরা। হাসদেও বাস্তুতন্ত্রটিতে প্রচুর পরিমাণ কয়লা সঞ্চিত রয়েছে। কয়লা মন্ত্রকের ম্যাপ অনুযায়ী, হাসদেও আরান্ড কোলফিল্ডে ১৮৭৮ বর্গ কিমি জুড়ে এক বিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুত রয়েছে, যা বনভূমি নিয়ে গঠিত।
উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় পণ্যের উপর জোর দেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর সেই লক্ষ্যেই ২০২০-তে ৪০টি নতুন কয়লা খনি তৈরিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে কেন্দ্র। এই কয়লাখনিগুলির সিংহভাগ হাসদেও আরান্ড অরণ্যাঞ্চলে অবস্থিত। এই এলাকায় কৃষি-নির্ভর একাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে পারার পর থেকেই আন্দোলনে নেমেছেন তারা।
হাসদেওয়ের ১৮টি কয়লা খনি বা ব্লক বিভিন্ন কোম্পানিগুলিকে দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত ৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত কর্পোরেশনকে চারটি ব্লক বরাদ্দ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরা প্রত্যেকেই ভারতের অন্যতম শক্তিশালী কর্পোরেশন। আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এইল)-কে এশিয়ার দ্বিতীয় ধনী ব্যবসায়ী গৌতম আদানির নেতৃত্বে ব্লক বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে।
এইএল হাসদেওতে আনুমানিক ৯৬৪ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের চুক্তি করে। এটি পেতে কমপক্ষে ৭৫০০ হেক্টর জমি এবং বন প্রয়োজন। এই জমি ও বনের উপর স্থানীয় সম্প্রদায়গুলি প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। যা নিয়েই বিতর্ক দানা বেধেছে। এইএল কাজ শুরু করার পর থেকেই আদিবাসীরা জোটবদ্ধ হয়েছে। দশকব্যাপী চলা এই আন্দোলন পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় দৃষ্টান্ত।
লং মার্চ এগিয়ে চলেছে রায়পুরের দিকে
চলতি বছরের ২ অক্টোবর ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দারা সমবেত হয়ে ‘বন সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন। ৪ তারিখ তাঁরা ছত্তীসগড়ের রাজধানী রায়পুরের উদ্দেশে ৩০০ কিলোমিটার ব্যাপি ‘লং মার্চ’ শুরু করে। ১৩ তারিখ সেই মিছিল রায়পুর পৌঁছয়। ২০১১ সাল থেকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন পরিবেশকর্মী অলক শুক্লা। রাজ্যপালের সঙ্গে দেখাও করেন তাঁরা।
কংগ্রেসের তরফে অনেক আগেই গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে রাহুল গান্ধি হাসদেওতে আসেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তাও দেন। কিন্তু ২০১৯ সালে কংগ্রেস ছত্তীসগড়ে ক্ষমতায় আসলেও এই বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি তারা। এমনটাই অভিযোগ অলক শুক্লার।
গ্রামসভায় সমবেত হয়েছেন গ্রামবাসীরা
বাণিজ্যিক ভাবে কয়লা উত্তোলনের ছাড়পত্র দিচ্ছে মোদি সরকার, তার বেশির ভাগ জুড়ে রয়েছে আদিম অরণ্য। যা দশকের পর দশক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ধরে রেখেছে । সেই আদিম অরণ্যগুলি আজ বুলডোজারের দানবীয় শব্দে কাঁপছে। হাসদেও আরান্ড বনভূমি অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের তরফে এই কয়লাখনির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠানো হয়েছে ।
এই কয়লাখনির কাজ হলে অন্তত পাঁচটি গ্রামের ৬ হাজার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আশ্রয় হারাবেন। তাছাড়া কয়েক হাজার হেক্টর জমিজুড়ে পুরনো গাছগাছালি ধ্বংস করে দিতে হবে খনির জন্য। ইতিমধ্যেই কয়লাখনির জন্য কাটা পড়েছে প্রচুর প্রাচীন গাছ। যদি কয়লাখনি আরও সম্প্রসারণ করা হয় তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সমূহ বিপদের মুখে পড়বে।