শারীরিক সমস্যা মানেই শুধুমাত্র যেমন কোনও কঠিন রোগ বা ব্যাধি নয়, ঠিক তেমনই মানসিক রোগ বা সমস্যা বোঝাতে শুধু যে ডিপ্রেশন (depression), অ্যাঙ্কজাইটি (anxiety), স্কিজোফ্রেনিয়া(schizophrenia) বা অ্যালঝাইমারের (alzheimer) সমস্যা, তা কিন্তু নয়। এগুলি অনেকটা হিমশৈলের চূড়ার মত। মানসিক স্বাস্থ্যর ব্যাপ্তি আরও গভীর। শারীরিক সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সহজে বোঝা যায়। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বা সমস্যা ঘিরে রয়েছে সচেতনতার অভাব। তাই, শরীরের খোঁজ রাখলেও আমরা মনের খোঁজ রাখি না। কোভিডকালে সমান ভাবে প্রভাবিত মন ও শরীর। কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে আমরা যত ব্যস্ত। তার সিকিভাগও মনের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি না কেউই। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে শরীর ভাল রাখত মনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া স্বাস্থ্য অপরিকল্পনীয়। আর এই মেন্টাল হেলথ(mental health) বজায় রাখতে মেন্টাল হাইজিন(mental hygiene) অত্যন্ত জরুরী জানাচ্ছেন বিশিষ্ট মনোবিদ ডাঃ দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ ডে(World Mental Health Day) উপলক্ষ্যে মেন্টাল হাইজিন কি এবং কেন তা নিয়ে কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ককে বিষদে জানালেন চিকিত্সক।
মেন্টাল হাইজিনের মাধ্যমে জীবনযাপনে সুন্দর একটি ভারসাম্য বজায় থাকে
মেন্টাল হাইজিন(mental hygiene) কি?
শরীর সুস্থ রাখতে আমরা বেশ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। সেরকমই মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে মেন্টাল হাইজিন বা মনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন। এই মেন্টাল হাইজিন মানতে গেলে আলাদা করে কিছু করার প্রয়োজন নেই শুধুমাত্র চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে সুন্দর একটি ভারসাম্য বজায় থাকে। বেশ কিছু পুরনো বা ছোটবেলার অভ্যেস যেগুলো কালের নিয়মে আমরা ভুলে গিয়েছি সেই অভ্যেসগুলো ফিরিয়ে আনা দরকার।
তাই মেন্টাল হাইজিন (mental hygiene) বজায় রাখতে এই কাজগুলি করা যেতে পারে-
সর্বোপরি আপনার মনের যত্ন নিন
মন ভাল রাখার চেষ্টা করুন। তাই বলে প্রত্যেক দিনই যে আপনি হাসিখুশি থাকবেন তা নয়। ঋতুর যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি মেজাজ ভাল বা খারাপ থাকতেই পারে। তবে যেদিন মেজাজ খারাপ থাকবে সেদিন নিজের বাড়তি যত্ন নিন। রাগ, মন খারাপ লাগা, এই আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আবেগতাড়িত হবেন না। মন ভাল রাখতে সঠিক পরিমাণে ঘুমোনো এবং সুষম আহার খান। শুনতে সহজ লাগলেও ভেবে দেখুন অধিকাংশ দিনেই এই দুটি কাজ আমাদের ঠিক ভাবে করা হয় না।
আত্ম-সম্মান বজায় রাখুন এবং নিজের ওপর ভরসা রাখুন
মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখতে এটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। আপনি যে রকম, সেভাবেই নিজেকে গ্রহন করুন। অযথা অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করবেন না। নিজের ওপর ভরসা রাখুন। অন্যকেও ভরসা করতে শিখুন।
সফ্ট স্কিল হিসেবে এখন চাকরির বাজারে ট্রেন্ডিং ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন
এর মানে এটা একদমই নয় যে কষ্ট, রাগ বা খুশি এই আবেগগুলো মনে চেপে রাখবেন। মন ভাল রাখতে আবেগের বহিঃপ্রকাশ দরকার। তবে এই বহিপ্রকাশের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে আপনাকে। কষ্ট পেলে প্রয়োজনে একা বা প্রিয়জনের সামনে কেঁদে নিন। দেখবেন হালকা লাগবে। একই ভাব রাগ হলে সেটা চেপে না রেখে ওয়ার্কআউট বা অন্য কোনও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ করুন। এ ভাবে আবেগুলোকে সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করান নাম হল ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স।
সীমাহীন ইচ্ছা-আকঙ্খা রাখবেন না
নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে অযথা এমন কোনও লক্ষ্য স্থির করবেন না যা অসাধ্য। আপনার সামাজিক, আর্থিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সহজ লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। নিজের সঙ্গেই নিজেকে তুলনা করুন, উন্নতির পথ মসৃণ হবে অন্যদের সঙ্গে অহেতুক তুলনা করবেন না। এতে কষ্ট বাড়বে। মন খারাপ হবে। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা মনে বাসা বাঁধবে।
ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করুন নেতিবাচক চিন্তাধারা বর্জন করুন
অনেক সময় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। একেবারে ভেঙে পরবেন না। সময় পরিবর্তনশীল, তাই মনে রাখবেন আবেগতাড়িত না হয়ে কীভাবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব সেই চেষ্টা করতে হবে।
ব্যস্ত জীবনের থেকে মাঝে মধ্যে একটা ব্রেক নিন
বর্তমানে আমরা প্রত্যেকেই ব্যস্ত। ক্রমাগত যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটে চলেছি। এই ইদুর দৌড়ে গা ভাসালেও মন একবারে ভাসিয়ে দেবেন না। ব্যস্ত জীবনে মাঝে মধ্যে ব্রেক নিন। এই সময় নিজের পছন্দের কাজগুলো করুন। যেমন ছবি আঁকা, প্রিয়জনেদের সঙ্গে সময় কাটান, গার্ডেনিং, কুকিং বা বেকিং করতে পারেন। যে কোনও সৃজনশীল কাজে মন দিন। দেখবেন মন ভাল থাকবে। একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
অন্তত ছুটির দিনে মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকুন
ডিজিট্যাল ডিস্ট্যান্সিং প্রাকটিস করুন
কোভিডকালে ফোনে, ল্যাপটপে বা ডেস্কটপের সামনে আমরা প্রত্যেকেই ইদানীং বেশি সময় কাটাই। এই ‘ইনক্রিজড স্ক্রিন টাইমের (increased screen time)’ কারণে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বাড়ছে। তাই অন্তত ছুটির দিনে চেষ্টা করুন মোবাইল ফোনের থেকে দূরে সময় কাটাতে। মন ভাল করতে হাটুন, গান শুনুন। রিল্যাক্স করুন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করুন।
আর মনে রাখতে হবে যে মন ভাল রাখাটা নিত্য দিনের কাজ, যেমন ঘুমোনো, খাবার খাওয়া, শরীরচর্চা করার মতই গুরুত্বপূর্ণ। মন খারাপ থেকেই শরীর খারাপ, এই কথা তো সেই কবেই বলেছেন ফেলুদা!
(ডাঃ দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, কনসালটেন্ট জেরিয়াট্রিক সাইকিয়াট্রিস্ট, কলকাতা অ্যান্ড মেম্বার, ইন্টারন্যাশনাল সাইকোজেরিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন)
ছবি সৌজন্য: Pixabay