হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো। সেই কবেই বলেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। গতকাল তা আবার প্রমাণিত। খবর এসেছিল ২৮ মে সংসদের নতুন ভবন উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিকে ডাকাও হয়নি। এই খবর আসার পরেই প্রথম প্রতিক্রিয়া আসে নবান্ন থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দেন, রাষ্ট্রপতিকেই এই উদ্বোধনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তিনি জানিয়ে দে,ন তৃণমূল এই অনুষ্ঠান বয়কট করবে। কিছুক্ষণ পরেই ডেরেক ও’ব্রায়েনের টুইটার হ্যান্ডেল থেকেও অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরেই প্রথম সমর্থন আসে আপের কাছ থেকে। সিপিআই গতকাল রাতেই সমর্থন দেয়। আজ সকাল থেকেই শিবসেনা, সিপিএম সহ ১৯টি দল জানিয়ে দিয়েছে তারা এই অনুষ্ঠান বয়কট করছে। অতএব খোলা চোখে এক ভবিষ্যতের ঐক্যমঞ্চ দেখাই যাচ্ছে। তা-ই বিষয় আজকে— হবে কি বিরোধী ঐক্য?
হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে বিরোধীদের মধ্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাড়তে থাকা ফাটল, রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই কমতে শুরু করেছিল, এবার সেই ফাটল অনেকটাই কমে ২০২৪কে সামনে রেখে সম্ভবত এক বৃহত্তর বিরোধী ঐক্যের শুরুয়াত হয়ে গেল। আসুন সেই সম্ভাবনা কতটা সত্যি দেখা যাক। চাঁদ সদাগরের কথা মনে আছে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখনও বলেছেন, যেই হাতে পূজি আমি দেব শূলপাণি, সেই হাতে নাহি পূজি চ্যাং মুড়ি কানি। মানে যে হাতে শিবের পুজো করি সেই হাতে মনসার পুজো করব না। শেষমেশ অন্যহাতেই মনসার পুজো করে পুত্রের প্রাণ আর নিজের ব্যবসা মর্যাদা বাঁচিয়েছিলেন চাঁদ সদাগর। হ্যাঁ নিমরাজি হয়েও মানুষ কাজ করে। কিন্তু রাজনীতি কি অতটাই সরলরেখায় চলে? অন্যতম বিরোধী দলের অন্যতম নেতার সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়া হল, এমন এক অবস্থায় কি চুপ করে থাকতে পারতেন মমতা, অভিষেক, তৃণমূল, এসপি, অখিলেশ বা বিআরএসএর-কে চন্দ্রশেখর? এঁদের বিরোধিতার মূল অবস্থানটাই কি নড়বড়ে হয়ে যেত না? এ রাজ্যে কংগ্রেসের, সিপিএম-এর নেতারা বিশেষ করে মুসলমান মানুষজনের কাছে চোখে আঙুল দিয়ে কি বলতেন না, যে ওই দেখো তৃণমূল নেত্রী বিজেপির এতবড় অন্যায়ের পরেও চুপ করে বসে আছেন? বিশ্বাসযোগ্যতায় কি চিড় পড়ত না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপি বিরোধিতায়, যে তীব্র বিজেপি বিরোধিতার ফলেই মুসলমান মানুষজনের বিরাট ভরসা, বিরাট আশ্রয় তৃণমূল দল এবং তার নেত্রী। অতএব রাহুলের পাশে মমতা দাঁড়ালেন, অখিলেশ দাঁড়ালেন গোছের আলগা মন্তব্য না করে বরং আসুন অন্তত তিনটে কারণ দেখা যাক, যে কারণে এখনই কংগ্রেসের নেতৃত্বে এক বৃহত্তর বিরোধী ঐক্য সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | দু’ চাকায় মৃত্যুদূত
প্রথম কারণ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড আর কর্নাটক, এই ছ’টা ছোট বড় রাজ্য ছেড়ে দিলে বাকি জায়গায় বিজেপির লড়াই আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে। মানে বাদবাকি ১৪-১৫টা রাজ্যে রাজনৈতিক সমীকরণে অবিজেপি, অকংগ্রেসি দলই বিকল্প চেহারা। তাই কুকুর ল্যাজ নাড়াবে না ল্যাজ কুকুরকে নাড়াবে সেই প্রশ্ন তো থেকে যাবে। এর পরের বিষয়ে আসি। দেশে একমাত্র কমিউনিস্টরাই কংগ্রেসের সঙ্গে এক ঐকবদ্ধ মঞ্চে আসতে একপায়ে খাড়া কিন্তু বিধি এখানেও বাম। কমিউনিস্টদের হাতে একমাত্র রাজ্য কেরল, কিন্তু সামনে কারা? কংগ্রেস। ধরুন আগামিকাল ওয়েনাড়ে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেল, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী প্রার্থী হলেন, রাজ্যের সিপিএম কি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সমর্থন করবেন? তিন নম্বর বিষয় হল এই আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই তীব্র কংগ্রেস বিরোধিতা থেকেই গড়ে ওঠা। তৃণমূল, বিজেডি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আপ, এসপি, জনতা দলের প্রত্যেক বিভাজন, তেলঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি, শিবসেনা, এমনকী এনসিপি বা ডিএমকে সমেত প্রত্যেক দলের সৃষ্টি হয় কংগ্রেসের বিরোধিতায় বা কংগ্রেসের মধ্যের তিক্ত বিভাজনের ফল, কাজেই এদের পক্ষে চট করে কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া কঠিন। পুরনো ঘা সামনে এসে পড়ে, হঠাৎ তিক্ততা বেড়ে যায়। আচ্ছা মানুষ কী ভাবছেন? কংগ্রেসের নেতৃত্বে কি কোনও বিরোধী ঐক্য সম্ভব?
আসলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত টানা রাজত্ব কংগ্রেসের, তারপরেও ইন্দিরার দ্বিতীয়বারের সরকার, রাজীবের সরকার, ১০ বছরের ইউপিএ সরকার এবং দেশের বাড়তে থাকা দারিদ্র, বেকারত্ব, অনুন্নয়নের দায় তো কংগ্রেসকে নিতেই হবে। অন্তত বিজেপি সেই লজিকটা মানুষের সামনে এনে হাজির তো করেছে, মানুষের একটা বড় অংশ তা বিশ্বাসও করেছে। আজ ১০ বছরের মধ্যেই আবার কংগ্রেসকে সামনে রেখে গঙ্গাজল তুলসীপাতা হাতে নিয়ে এক বিরোধী ঐক্য ঝপ করে তৈরি হবে এবং তা বিজেপির মতো এক সংগঠিত দলকে হারিয়ে দেবে তা ভাবাটা একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছে। কিন্তু যে বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠছে, সে ঐক্যের ফলে আগামিদিনে রাজনীতির গতিপথ কিছুটা হলেও যে বদলাবে তার ইঙ্গিত এখন খুব পরিষ্কার।