গত পাঁচ বছরে দিল্লি সরকারের বিভিন্ন গ্রামীণ প্রকল্প, সে মনরেগা হোক বা হাউজিং প্রজেক্ট হোক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে বিশেষ অনুদানের হিসেব জুড়লে ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলে দিল্লি সরকারের দাবি। এদিকে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন গ্রামীণ প্রকল্পে নাকি পাঁচ বছরে ৪.৮ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, এ হল রাজ্য সরকারের দাবি। যতক্ষণ না অন্য হিসেব সামনে আসছে, আমাদের এই হিসেবকেই মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে পার্বত্য জেলার অনুদান বা খরচের হিসেব ধরা হয়নি। তো যাই হোক, এটা অন্তত পরিষ্কার যে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং কালিম্পং জেলা বাদ দিলে বাকি গ্রামীণ জেলাগুলোতে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের মাধ্যমে খরচ হয়েছে ৮.৪ লক্ষ কোটি টাকা। আমি এই নির্বাচনের ফলে যে মধুভাণ্ডার হাতে পাওয়া যাচ্ছে তার একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র। এর মধ্যে বিভিন্ন সুযোগ যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া কাটমানি ধরা নেই, ধরা নেই ৫ বছর ধরে ক্ষমতার তূরীয় নেশার আনুপাতিক মূল্য। কেবল দিল্লি সরকার বা রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে যা খরচ করছে, সেটাই ৮.৪ লক্ষ কোটি টাকা। মানে ভদ্রস্থ বাজার চলতি হিসেবে ১০ শতাংশ পকেটে ঢোকালে ঢুকবে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিনিমাম চুরি এবং ভদ্রস্থ চোর হলে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ঠিক সেই কারণেই মাটি কিংবা ইট বের করা সারি সারি বিবর্ণ বাড়ির পাশাপাশি হঠাৎ খাড়া হয়ে যায় জাহাজ বাড়ি, প্রেমচিহ্ন খচিত বাড়ি, পেল্লায় অট্টালিকা, সুইমিং পুল, গলায় ঝোলে সোনার চেন, বাইকে নয় দাদা এখন ফরচুনারে ঘোরেন। তার জন্য কিছু খুন হবে না তো কি গঙ্গাজল ছড়ানো হবে? তাই খুন হচ্ছে, আজ থেকে নয়, যবে থেকে বাংলার রাজনৈতিক মহল এই মধু ভাণ্ডারের খবর পেয়েছেন, তবে থেকেই রক্ত ঝরছে পঞ্চায়েত নির্বাচনে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, পঞ্চায়েতে হিংসা বন্ধ হবে? কোন ফর্মুলায়?
এই পঞ্চায়েতের দুর্নীতির মোট বহর দেখেই চমকে উঠবেন না, এই দুর্নীতির ব্যাপ্তি দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। যদিও তা কেউ জানে না, আজ হঠাৎ আমি আপনাদের বলছি তেমনও তো নয়। সব্বাই জানেন, সব্বার চোখের সামনেই হয়ে চলেছে। মানে জেলা প্রশাসনের প্রত্যেকে জানেন যে দুর্নীতির বহর এবং ব্যাপ্তির যাবতীয় খুঁটিনাটি, ডিএম থেকে ব্লক অফিসের কনিষ্ঠা কেরানি পর্যন্ত জানেন, কিন্তু কিচ্ছুটি করেন না, কারণ ওই যে ব্যাপ্তি, প্রত্যেক দেবতার জন্য যথাযোগ্য দক্ষিণা ভোগ রাখা থাকে। উপর থেকে নীচে পর্যন্ত এই ভাগ বাটোয়ারার শরিক, ছোট ভাগটুকু আসে দুই কি তিন হাজারের মতো, সামান্য হতেই পারে কিন্তু আছে।
আরও পড়ুন: Aajke | দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল
কারা পাবে না সেই ভাগ? যারা বেয়াড়া, যারা বিরোধী, যারা প্রতিবাদ করে, যারা অন্য দলের, তারা ভাগ পায় না। কিন্তু তারা জানে ভালো করেই যে ক্ষমতায় আসতে পারলেই এই মধুভাণ্ডার তাদের, যারা ক্ষমতায় আছে, তারাও বিলক্ষণ জানে যে ক্ষমতা চলে গেলে মধুভাণ্ডারের দখলদারিও শেষ। অতএব জোর লড়াই, লড়াই মধুভাণ্ডারের। কাজেই রক্ত ঝরবে, আগেও ঝরেছে, এখনও ঝরছে, পরেও ঝরবে যদি না গোটা রাজ্যে অন্তত হাজার ৮ পঞ্চায়েত প্রধান, হাজার খানেক পঞ্চায়েত সমিতির মাথা, শ’ দুয়েক জেলা পরিষদ সদস্যের জেল হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। এই বিরাট মধুভাণ্ডারের দখলদারেরা তাদের চুরির জন্য কোনওদিন শাস্তি পায়নি, জেলে যায়নি। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে কতজন শেষ পর্যন্ত শাস্তি পাবে জানি না, কিন্তু আপাতত টাকা নিয়ে শিক্ষকের চাকরি দেব বলার মতো চোরের সংখ্যা কমেছে। ঠিক সেরকম এক কড়া নজরদারি দরকার এই পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডারে। তা না হলে হিংসা বন্ধ হবে না, হঠাৎ বিজেপির ল্যাজ ধরে রাজভবনে ঢুকে পড়লেই সব কিছু বোঝা যায় না, বোঝার জন্য একটা মগজও দরকার, কাব্য করছেন শেক্সপিয়ার আওড়াচ্ছেন, আওড়ে যান। আপনাকে ওই নির্বাচন কমিশনের মাথাতে বসালেও ওই একই ফলাফল হত, ওই একই রক্তপাত হত, নির্বাচন কমিশন বা রাজীব সিনহার হাতে জাদুকাঠি তো নেই, যা দিয়ে শান্তি আনা যাবে। পঞ্চায়েতের খরচের উপর নজরদারি বাড়ানো হোক, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পরে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার কেড়ে নেওয়া হোক। চুরি থাকবে আর চুরির মালের ভাগ বাটোয়ারার জন্য লড়াই থাকবে না, তা হয় না। আমরা মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই খুনোখুনি, বোমাবাজি, আতঙ্কের পিছনের কারণ কি ওই পঞ্চায়েতের বিরাট মধুভাণ্ডার? পঞ্চায়েতের দুর্নীতিই কি এই অশান্তির মূল কারণ নয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
একজন সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষও জানেন আগুন না নিভিয়ে চুলোর ওপরে হাঁড়ি রাখা থাকলে, জল ফুটবে, খাবার পুড়বে। লক্ষ কোটি টাকার হাতছানি আছে, দুর্নীতি আছে আর তা নিয়ে খুনোখুনি বন্ধ করে দেবে এক ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার ওই নির্বাচন কমিশন? সম্ভব নাকি? আচ্ছা, এই সব সত্যিগুলো আমি জানি, আমরা ক’জন জানি এমনও তো নয়, সব্বাই জানেন, কিন্তু কেউই কিছু করছেন না। প্রত্যেকেই এই সুযোগে এই সামগ্রিক অশান্তির আগুনে তাঁদের নিজের নিজের রাজনীতির রুটি সেঁকে নিতে ব্যস্ত। হ্যাঁ, আমাদের চোখে গগলস, কোট প্যান্ট শোভিত রাজ্যপালও সেই রাজনীতিটাই করছেন।