দুর্নীতি আছে, মানুষের টাকা মেরে কোটি কোটি টাকা কামানোর ইতিহাস আছে, বাড়িতে লক্ষ কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি আছে। বুদ্ধ থেকে রামকৃষ্ণ সম্পদ আহরণ আর লালসা ভোগের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন, তাতে না অর্থ সম্পদের লালসা কমেছে, না জীবনের অন্য লালসা, তৃষ্ণা, লাস্ট এতটুকু কমেছে। এক শ্রেণির মানুষ এই শর্টকাটের রাস্তা ধরবেই আর তাদেরকে ঠেকানোর জন্যই রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সি থাকবে, পুলিশ, আইবি, সিবিআই, ইডি ইত্যাদি। আধুনিক রাষ্ট্র উদ্ভব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নজরদারিও বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে রাষ্ট্রের অসম্ভব গরিব আর অত্যন্ত বড়লোকদের এক অংশ এই আইনের তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু বাকি এক বিরাট জনগণ আইন মেনে চলাটাই শ্রেয় বলে মনে করেছেন। কারও বাড়িতে পুলিশ যাওয়া মানে এক সামাজিক চাপ তৈরি হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তা উদ্দেশ্যমূলক হয়েছে? ধরুন স্বাধীনতার আগে হঠাৎ পাড়ার লোকজন জানতে পারলেন ছেলেটি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাই পুলিশ এসেছে। তখন এই সামাজিক চাপ আর থাকতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তার প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু গত ৯ বছরের রাষ্ট্র কাঠামোর চরিত্র সাফ বলে দেয়, আপনি সরকার বিরোধী হলে যে কোনও অজুহাতে আপনাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তার সঙ্গে দুর্নীতি থাকা বা না থাকার কোনও সম্পর্কই নেই। কাজেই যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আগাম জানিয়ে রাখেন যে অভিষেক গ্রেফতার হতে পারে তখন সেটাই খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়, গ্রেফতার হতেই পারতেন অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবল, প্রফুল্ল প্যাটেল, তাঁরা দল বদলেছেন, এখন ইডি অফিসারদের ঘাড়ে ক’টা মাথা যে তাদের দরজায় কড়া নাড়ে? বিষয় আজকে সেটাই, অভিষেককে ইডি গ্রেফতার করতে পারে।
মমতা বলেছেন, কিন্তু সেটা কি খুব নতুন কিছু, রাজ্যে একের পর এক গ্রেফতার তো হচ্ছে আর শুরু থেকেই তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আছে। এবং ইডি সূত্র তো এতদিনে অন্তত পাঁচ-ছ’ বার জানিয়েছে যে গরু পাচার মামলা, কয়লা পাচার মামলাতে অভিষেক যুক্ত। সংবাদমাধ্যমের একাংশে তা ফলাও করে বলাও হয়েছে। হতেই পারে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল আর তাদের নেতদের মধ্যে দুর্নীতির কথা তো সবাই জানে। আমার প্রশ্নটা ঠিক সেটা নয়। আমার প্রশ্ন দুটো, প্রথম প্রশ্ন হল এই মামলা সাজানো হচ্ছে কি না? কারণ ক’দিন আগেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপস অ্যান্ড বাউন্ডের দফতরে রঘু ডাকাতের দল থুড়ি ইডির দল ঢুকেছিল। তারা চলে আসার পরে দফতরের কর্মচারীরা দেখেন বিশেষ একটি কম্পিউটারে বেশ কিছু ফাইল ডাউনলোড হয়েছে, সেগুলোর ডাউনলোডের সময়ে ইডি অফিসারদের দখলেই ছিল ওই কম্পিউটারটি।
আরও পড়ুন: Aajke | দত্তপুকুরের রহস্যের নেপথ্যে
তদন্ত চলছে চলুক। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল, অনেকেরই মনে পড়ে যাবে হাজারিবাগ থেকে মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ আছে এই অভিযোগে স্ট্যান স্বামী এক অশীতিপর জেসুইট চার্চের ফাদারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁকে জেলে অকথ্য অত্যাচার করা হয়, তিনি জেলেই মারা যান, তাঁর কম্পিউটারে ঠিক এরকমই বেশ কিছু জিনিস ছিল যা পরে জানা যায়। জানা গিয়েছিল, সে সব ফাইল, চিঠি কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করার পরে ডাউনলোড হয়েছিল। আনে পদ্ধতিটা নতুন নয়। অন্যদিকে ইডি এই তথ্য এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার পরে খানিক বিব্রত, তাঁরা ভেবেছিলেন এটা ধরা পড়বে না। তাঁদের এক্সপ্লানেশন ক্লাস সিক্সের ছাত্রের অজুহাতের থেকেও দুর্বল। ইডির এক অফিসারের সন্তানের স্কুলের বিষয়ে তিনি ওই কমপিউটারে বসে সার্চ করছিলেন, তখন ওই ফাইলগুলো ডাউনলোড হয়। একবার পুরো ঘটনাটা ভাবুন, ইডি অফিসারেরা তদন্তে গেলেন, হাই প্রোফাইল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে। সেখানে তদন্ত চলাকালীন এক অফিসার ওই দফতরের একটা কম্পিউটারে তাঁর সন্তানের স্কুলের বিষয়ে গুগল সার্চ করছিলেন। ধোপে টিকবে এই অজুহাত? কেউ বিশ্বাস করবে? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইডি অফিসারেরা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে গিয়ে সেই দফতরের কম্পিটারে বসে ব্যক্তিগত কাজ করতে গিয়ে না বুঝেই কিছু ডকুমেন্টস ডাউনলোড করে ফেললেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এটা কি আসলে এক ষড়যন্ত্র নয়? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
এবারে আসি দু’ নম্বর প্রশ্নে, অপরাধীরা যদি রাজনৈতিক শিবির বদল করেই পার পেয়ে যায়, তাহলে এসব দুর্নীতি, দুর্নীতি বিরোধী কথাবার্তা, জ্ঞান, না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা গোছের বাওয়ালের মানেটা কী? আসলে ইডি বা বলা ভালো ইডির মালিক, প্রভুরা ঠিক কী চাইছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতি। যদি তিনি কোনও দুর্নীতি আদৌ করে থাকেন, তা খুঁজে বার করতে ইডিকে তো পাঠানো হয়নি, পাঠানো হয়েছে বশ্যতা মানার প্রোপোজাল দিয়ে। সব মিলিয়ে এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান আসলে রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকারের এক অস্ত্র, এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কাজেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে ইডি হানা দিল, তিনি গরু পাচার না কয়লা পাচারের সঙ্গে বা আরও কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বা জড়িত নয় সেটা এখানে বিবেচনার বিষয়ই নয়, বিষয়টা হল বিজেপি অভিষেক বা তাঁর দলকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চায়। আর সেই বশ্যতা মানানোর চাপের খেলাই চলছে সারা দেশ জুড়ে।