নমস্কার।
আমি জয়ন্ত ঘোষাল বলছি। ঘোষাল নামায় আবার এসে গেছি আপনাদের সামনে। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় দুর্নীতি। কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সতপাল মালিক পুলওয়ামা আক্রমণ নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। তাঁর কারণ, থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকার যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছে দেশে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভারতের একজন প্রাক্তন রাজ্যপালের বক্তব্য সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদি সরকার বিষয়টিকে ইগনোর করার কৌশল নিয়েছেন।
অবজ্ঞা করা হলে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব কি কমে যায়? কৌশলগত ভাবে মিডিয়ায় পাদপ্রদীপের আলোয় নাও থাকতে পারে বিষয়টি। কিন্তু সত্য, সে বড় কঠিন। সে কখনও করে না বঞ্চনা।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লি বিধানসভার ভিতর নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। সে ব্যাপারেও কোনও পাল্টা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তিনি যা বলেছেন, সে সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও জবাব দেওয়া হয়নি। যদিও অভিযোগকারী একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী।
জবাব দেওয়া না হলেও আমরা দেখলাম, সতপাল মালিকের কাছে সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট একটা পুরনো বিমা মামলা নিয়ে তদন্তে হাজির। কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধেও একইরকম সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট-এর আক্রমণ। যাঁরা অভিযোগ করছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট পাল্টা দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করছে। তাতে আম জনতার মধ্যে কি এই ধারণা হচ্ছে না যে, অভিযোগ করলে তদন্ত আর অভিযোগ না করে, ‘জো হুজুর’ ভূমিকা নিলে, সে মুখ্যমন্ত্রী হোন বা রাজ্যপাল, কোনও বিপদ নেই? সুতরাং, সুরক্ষিত থাকতে গেলে চলো নিয়ম মতে। বলো, হেইল হিটলার। নমস্কার জানাও কর্তৃত্বকে। এমনটাই তো দেখা গেছিল একদা জার্মানিতে।
আজ আলোচনার বিষয়টা কিন্তু সিবিআই এনফোর্সমেন্ট নয়, আলোচনার বিষয়টা হল দুর্নীতি। আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্নই বারবার জাগছে যে, ভোটের সময় দুর্নীতি কি ইস্যু হয়? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ১৫ আগস্ট লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি দুর্নীতিকে নির্মূল করবেন এ দেশ থেকে। ‘চুরি বিদ্যা, বড় বিদ্যা। যদি না পড়ে ধরা।’ কোনও সন্দেহ নেই, নরেন্দ্র মোদি সরকারের দশ বছর অতিবাহিত। সেরকম বড় মাপের কোনও দুর্নীতি কোনও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি।
বিরোধীদের কাজ দুর্নীতিকে ফাঁস করা। যেমনটা হয়েছিল বোফর্সের সময়। ভারতের কোনও বিরোধী দল শাসকদলের বিরুদ্ধে এরকম কোনও বড় দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য সহ প্রমাণ সংসদে বা সংসদের বাইরে পেশ করতে পেরেছে কি? কিন্তু বিরোধী, তা সে আঞ্চলিক হোক বা জাতীয়, সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু বহু দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। সেই দুর্নীতিগুলোকে নিয়ে বিজেপি তাদের প্রচার অভিযান শুরু করেছে। দুর্নীতি-মুক্ত ভারত গঠনের আওয়াজ তুলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটের সময় দুর্নীতি কাজ করে কি করে না?
রাজীব গান্ধী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন দেশের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন কল্পনা রাই। তিনি দাউদের একজন অনুচরকে তাঁর ‘ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’র অতিথিশালায় থাকতে দিয়েছিলেন বলে তাঁকে টাডা-তে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি টাডা কোর্টের নির্দেশে জেল হাজতে থাকা অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচন লড়েছিলেন এবং বিপুল ভোটে জিতেছিলেন।
ভারতে হাজি মস্তানের নমুনা অনেক রয়েছে। কীভাবে উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে, এমনকী দক্ষিণ ভারতেও বাহুবলীরা— তারা ভোটে জিতে রবিন হুড হয়ে যান। তার নমুনা পশ্চিমবঙ্গেও যে দেখা যায়নি, তা নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতিকে মানুষ ভোটের সময় কত বড় একটা ইস্যু করে?
এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা একদা আমাকে বলেছিলেন, আসলে ভারতের সমাজের পুরো পিরামিডটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। একদম শীর্ষ থেকে নীচে, অর্থাৎ সিংহ থেকে নীচের পিপীলিকা দুর্নীতি-মগ্ন। ভারতের ইতিহাসেও দুর্নীতির পরম্পরা আছে।
আমি একটা বই পড়েছিলাম। বইটির নাম ‘Corruption in Veda’। অর্থাৎ, বৈদিক যুগে দুর্নীতি। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকেও তো তস্কর-বৃত্তির যে ঘটনাবলি, তা দুর্নীতি ছাড়া আর কী? ‘রাজতরঙ্গিণী’তেও কলহন রাজ্যপাটের দুর্নীতির কথা বলেছেন। দুর্নীতি সমাজজীবনে ওতপ্রোতভাবে কীভাবে জড়িয়েছে বোঝা যায়, যখন বিয়ের সম্বন্ধের সময় ঘটককে কন্যাপক্ষ জিজ্ঞাসা করে, জামাই যা বেতন পায়, তার ওপরে কিছু উপরি আয় আছে কি না। অর্থাৎ, উৎকোচ বাবদ অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ জামাতা বাবাজির হয় কি না। সেসব আগাম জানতে চায় পাত্রীপক্ষ। এটা যদি সামাজিকভাবে গৃহীত মূল্যবোধ হয়, তাহলে ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ’— এটাই ভোটারের মানসিকতা হবে।
আরও পড়ুন: ঘোষাল নামা (Ghosal Nama) | হে বাঙালি তুমি কোথায়?
উৎকোচ দিয়ে আমরা পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত সর্বত্র কাজ করতে উৎসাহী। সকলের তো মামা থাকে না। কিন্তু উৎকোচ দিয়ে কাজ করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষক হওয়ার জন্য যেরকম শাসকদলের মন্ত্রী যদি উৎকোচ নিয়ে থাকেন, সেরকম উৎকোচ দেওয়ার ব্যাপারটাও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়াবহভাবে আছে। আর সেই কারণে, ভোটের সময় সুশাসন ইস্যু হয়। দুর্নীতি ভারতে ইস্যু হয় না। তাই যদি হত, তাহলে ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়’ হয়ে যেত। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারত, কোন শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি নেই?
আমি এই ‘ঘোষাল নামা’য় দুর্নীতির সপক্ষে বলতে আসিনি। দুর্নীতি নিপাত যাক— এটা তো আমরা সবাই চাই। আসলে, ভোটের সময় নির্বাচনী ইস্যু কি হয়? আপনারা বলতে পারেন, বোফর্সের সময় তো হয়েছিল। বোফর্স একটা শব্দ। সেই শব্দটা শব্দব্রহ্ম হয়ে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে বিরাটভাবে প্রভাব ফেলেছিল। রাজীব গান্ধীর রাজনৈতিকভাবে সর্বনাশ করে দিয়েছিল। যদিও সেই বোফর্স-এর দুর্নীতি আজও প্রমাণ হয়নি। উল্টে, মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী বোফর্স দুর্নীতি থেকে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছেন। তবে, একটা ভোট হয়েছিল। তার জবাবে এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা বলেছিলেন, আসলে দুর্নীতি নয়, তখন কংগ্রেস-বিরোধী প্রবল হাওয়া তৈরি হয়েছিল। একটা বিরাট কর্পোরেট লবি-ও কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছিল। তার সঙ্গে বোফর্স যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির সাহায্যে। বোফর্সের দুর্নীতি শুধু নয়, তার সঙ্গে দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়ে গেছিল।
বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মূল প্রচারটা আমি নিজে এলাহাবাদে গিয়ে দেখেছিলাম শুরু থেকেই। এলাহাবাদ উপনির্বাচন যখন হয়েছিল, তখনও মান্ডার রাজা বলছিলেন, দেশকা প্যায়সা ইতালিমে ভেজ রাহা হ্যায়। ইতালিমে শ্বশুরাল মে দেশ কা প্যায়সা যা রাহা হ্যায়। তো, এই যে দেশের পয়সা শ্বশুরবাড়িতে চলে যাচ্ছে, এটার মধ্যে একটা দেশাত্মবোধের হাওয়া তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। ঠাকুর বিশ্বনাথ সিংয়ের সেই প্রচার সাময়িকভাবে সফল হয়েছিল। যদিও মৃত্যুর আগে তিনি সোনিয়া গান্ধীর কাছে বোফর্স তদন্ত দাবি তোলার জন্য ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছিলেন। কেননা, তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর এই প্রচারের ফলেই জনসংঘ তথা বিজেপির রমরমা ভারতবর্ষে হল। তার জন্য তাঁর শেষ জীবনে অনুতাপ ছিল।
আজ এই পর্যন্ত। আপনারা আমাকেও জানান, আপনারা কী মনে করেন, দুর্নীতি নির্বাচনের ইস্যু হয়?