আপাতত ভারতবর্ষের বহু মানুষ, দেশের রাজনৈতিক মহল বলতে যা বোঝায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তাদের মন্ত্রণাদাতারা, তাদের টাকা জোগান দেনেওলারা, অবশ্যই সাংবাদিকরা কর্নাটকের দিকেই তাকিয়ে আছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন কর্নাটক কোন দিকে। অতএব আমরাও একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রথম যে বিষয় তা হল এক মিথ। বহু রাজনৈতিক পণ্ডিত মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন এক স্টেবল গভর্নমেন্ট, স্থায়ী সরকার। তো দেশের আইটি পাওয়ার হাউস, স্টার্ট-আপ পাওয়ার হাউস বেঙ্গালুরু যে রাজ্যের রাজধানী, সেই রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিরতা কতখানি? গত ৫০ বছরে কর্নাটকে মাত্র দু’জন মুখ্যমন্ত্রী নিজের টার্ম ৫ বছর পার করতে পেরেছেন, দুজনেই কংগ্রেসের। একজন হলেন দেবরাজ আর্স, ইনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ৭২ থেকে ৭৮ পর্যন্ত। ৭৮ দেখে, মানে ৬ বছর দেখে চমকাবেন না, এটা ওই জরুরি অবস্থার অবসান এবং তারপরে বিভিন্ন রাজ্যের ভোট ইত্যাদির তালেগোলে হয়েছিল। ৬ বছর নয়, ৫ বছরের কিছু বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দেবরাজ আর্স। এরপর সেই রেকর্ড সিদ্দারামাইয়ার, তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একটানা ৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মানে ৫০ বছরে ৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দুজন, দুজনেই কংগ্রেসের। এবং আর একটা তথ্য গত ৩০ বছরে কর্নাটক দেখেছে ১৫ বার মুখ্যমন্ত্রী বদল, হ্যাঁ ১৫ বার মুখ্যমন্ত্রী বদলেছে। বিজেপির ইয়েদুরিয়াপ্পাই চারবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মোট পাঁচ বছর কিছু মাসের মোট মেয়াদের মধ্যে। ৩০ বছরে ১৫ বার মুখ্যমন্ত্রী বদল বা দলবদলের মতো ঘটনা ঘটার পরেও আইটি হাব সরেনি, স্টার্ট-আপ সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বেঙ্গালুরু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সব থিয়োরিকে নস্যাৎ করে। এবং আরও দুটো তথ্য জানানোর পরে আসব এবারে কী হতে যাচ্ছে সেই কথায়।
সে দুটো তথ্য হল, বিজেপির চারজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, ইয়েদুরিয়াপ্পা, জগদীশ সেট্টার, বাসবরাজ বোম্মাই আর সদানন্দ গৌড়া। এর মধ্যে একমাত্র সদানন্দ গৌড়াই ভোক্কালিগা, বাকিরা কর্নাটকের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় গোষ্ঠী লিঙ্গায়েত থেকেই আসা। এবং এই চারজনই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বিজেপির পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এমনও নয়, এমনও নয় যে বিজেপির দল ভেঙে কংগ্রেস বিজেপির সরকার ভেঙেছে। না, একবারের জন্যও নয়, বিজেপি নেতৃত্বই তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী বদলেছেন। হ্যাঁ, কংগ্রেস ভাঙা হয়েছে অন্তত তিনবার। অন্য তথ্যটা হল, কর্নাটক কংগ্রেসের বহু নেতাই জাতীয় রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছেন, এস নিজলিঙ্গাপ্পা, বি ডি জাত্তি, যিনি পরে উপরাষ্ট্রপতিও হয়েছেন, বীরেন্দ্র পাতিল, দেবরাজ আর্স, বীরাপ্পা মৈলি ইত্যাদি। অন্য দলের মধ্যেও আছেন রামকৃষ্ণ হেগড়ে বা এইচ ডি দেবেগৌড়ার মতো নেতারা। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে কর্নাটক থেকে বিজেপির কোনও নেতা উঠে আসেননি। বি এস ইয়েদুরিয়াপ্পাকে দলের সর্বোচ্চ বডি পার্লামেন্টারি বোর্ডে রাখা হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে তাঁর কোনও ভূমিকাই নেই। এই নির্বাচনে বিজেপি হারলে তিনি কর্নাটকের রাজনীতিতেই বিস্মরণে চলে যাবেন। যদিও এখনও কেবলমাত্র লিঙ্গায়েত ভোট নিজেদের দিকেই রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর রোড শোতে এই প্রথম আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে, যা আগে নরেন্দ্র মোদির রোড শো রেকর্ডে ছিল না। এখন কর্নাটকে প্রতিটা রোড শোতে ইয়েদুরিয়াপ্পা হাত নাড়াচ্ছেন নরেন্দ্র মোদির পাশে দাঁড়িয়ে।
এবার আসি সেই লাখ টাকার কথায়, কী হতে চলেছে কর্নাটকে। দুটো সার্ভের কথা বলব, তার মধ্যে একটা সার্ভে এনডিটিভি-তে দেখানো লোকনীতি-সিএসডিএস-এর সার্ভে। গুরুত্বপূর্ণ সার্ভে, কেন? কারণ এনডিটিভির মালিক আদানি বলে, সিম্পল। দুই হল এঁরা ভোটে কে জিতবে তা নিয়ে কথা না বলে এক সামাজিক, রাজনৈতিক সমীক্ষাই চালিয়েছেন। দু’ নম্বর সার্ভে হল এবিপি–সি ভোটার সার্ভে। প্রথমে আসি লোকনীতি–সিএসডিএস সার্ভের কথায়। তাঁরা জিজ্ঞেস করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী পদে কাকে মানুষের বেশি পছন্দ? ৪০ শতাংশ মানুষ বলেছেন তাঁদের পছন্দ কংগ্রেসের সিদ্দারামাইয়াকে। ২২ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির বাসবরাজ বোম্মাই। জেডিএস-এর কুমারস্বামী দেবেগৌড়া পেয়েছেন ১৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন আর বিজেপির ইয়েদুরিয়াপ্পা, যিনি আপাতত লেপ্টে রয়েছেন মোদিজির সঙ্গে তাঁর দিকে সমর্থন মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের। কংগ্রেসের ডি কে শিবকুমার ৪ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। তার মানে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী চান ৪৪ শতাংশ মানুষ। বিজেপির দিকে ২৭ শতাংশ মানুষ আর জেডিএস-এর মুখ্যমন্ত্রী চান ১৫ শতাংশ মানুষ। যদিও ৫৬ শতাংশ মানুষের বক্তব্য তাঁরা দল দেখে ভোট দেন, ৩৮ শতাংশ ভোট দেন ক্যান্ডিডেট দেখে আর মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী দেখে ভোট দেন। কর্নাটকে প্রচার, বিজেপির বোম্মাই সরকার নাকি ৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার, প্রধানমন্ত্রী প্রচারে বলেছেন কংগ্রেস তো ৮০ শতাংশ কমিশন খেত, তার মানে কী? তার মানে কি এটাই যে বিজেপি কমিশনকে ৮০ থেকে ৪০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তো এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে খিল্লি জারি। কিন্তু করাপশন নিয়ে এই সমীক্ষা কী বলছে, ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করে বিজেপিই সবথেকে বড় দুর্নীতিবাজ দল, এটা আদানির চ্যানেলেই বলা হচ্ছে। কংগ্রেসকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করেন ৩৫ শতাংশ মানুষ, জেডিএস-এর দুর্নীতি বেশি, মনে করেন ৩ শতাংশ মানুষ।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দ্য কেরালা স্টোরি, আবার এক ডাহা মিথ্যে বিষ ছড়ানো সিনেমা
মোদিজির আরেক প্রচার কংগ্রেসের বংশানুক্রমিক শাসন। এ নিয়ে সমীক্ষা কী বলছে? সমীক্ষা বলছে, ভাই-ভাতিজাবাদ চালাচ্ছে বিজেপি, এমনটা মনে করে ৫৯ শতাংশ মানুষ, কারণ ইয়েদুরিয়াপ্পার ছেলে, কারণ বেল্লারি ভাইদের টিকিট দেওয়া, জারকিহোলি ভাইদের টিকিট দেওয়া, নিজের ফ্যামিলির মধ্যে টিকিট পেয়েছেন, বিজেপির সেই সংখ্যাটা ২৪। অন্যদিকে এই ভাই-ভাতিজাবাদের জন্য ৩০ শতাংশ মানুষ কংগ্রেসকে দায়ী বলে মনে করেন। সমীক্ষা বলছে ৪৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন কংগ্রেস কর্নাটকের উন্নতি করতে পারবে আর এই প্রশ্নে বিজেপি ১০ শতাংশ কম, ৩৭ শতাংশ মানুষ মনে করে, বিজেপির কাছেই আছে কর্নাটকের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। কর্নাটকের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী লিঙ্গায়েতদের ৬৭ শতাংশই কিন্তু এখনও বিজেপির পক্ষে, ভোক্কালিগাদের ৩৪ শতাংশ কংগ্রেসের আর ৩৬ শতাংশ জেডিএস-এর পক্ষে। যদিও মুসলমান ভোটারের ৫৯ শতাংশই কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষে বলে এই সমীক্ষা জানিয়েছে। এরপর যেটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ তা হল সমীক্ষায় কেবল গরিবদের ভোট কোনদিকে যেতে পারে তা বলা হয়েছে। ৫০ শতাংশ গরিব মানুষের ভোট যাবে কংগ্রেসের দিকে আর মাত্র ২৩ শতাংশ গরিব মানুষের সমর্থন আছে বিজেপির দিকে। তাহলে চলুন কোন ইস্যুতে এবার কর্নাটকে ভোট হচ্ছে দেখে নেওয়া যাক। সিএসডিএস–লোকনীতির এই সমীক্ষা আমাদের চমকে দেবে। কর্নাটকে যে করাপশন নিয়ে এত কথা সেই করাপশন বা দুর্নীতিকে এবারের ভোটের ইস্যু বলে মনে করেন মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ। ২৮ শতাংশ মানুষ বেকারত্বকে, ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রকেই এবারের কর্নাটক রাজ্য বিধানসভার ভোটের সবথেকে বড় ইস্যু বলেই মনে করেন। মূল্যবৃদ্ধি, অনুন্নয়ন, শিক্ষার অভাবকে ২১ শতাংশ মানুষ এবারের ভোটের ইস্যু বলে চিহ্নিত করেছেন। এবং এবার মাথায় রাখুন এই সব ইস্যু মানে দারিদ্র, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অনুয়ন্নয়ন, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি কোন শ্রেণির মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে? গরিবদের, যে গরিবদের ৫০ শতাংশের সমর্থন আছে কংগ্রেসের দিকে। সব মিলিয়ে গৌতম আদানির চ্যানেল সাফ জানাচ্ছে অ্যাডভানটেজ কংগ্রেস।
এবার চলুন এবিপি-সি ভোটার কী বলছে, দেখা যাক। কর্নাটকের রাজনৈতিক ভৌগোলিক বিন্যাসের কথা মাথায় রেখে কর্নাটককে ৬টা ভাগে ভাগ করা হয়, ১) গ্রেটার বেঙ্গালুরু রিজিয়ন, ২) ওল্ড মাইসুরু রিজিয়ন ৩) মধ্য কর্নাটক রিজিয়ন ৪) কোস্টাল মানে সমুদ্র তীরবর্তী কর্নাটক রিজিয়ন, ৫) মুম্বই কর্নাটক রিজিয়ন যা মহারাষ্ট্রের গা ঘেঁষা ৬) হায়দ্রাবাদ কর্নাটক রিজিয়ন যা নাকি তেলঙ্গনা রাজ্য ঘেঁষা। তো এবিপি-সি ভোটার জানাচ্ছে গ্রেটার বেঙ্গালুরু রিজিয়নের ৩২টা আসনে বিজেপি ১১–১৫, কংগ্রেস ১৫–১৯, জেডিএস ২-৪টে আসন পেতে পারে। ওল্ড মাইসুরু রিজিয়নে, এই এলাকা হল টিপু সুলতান আমলের পুরনো মহীশূর, যেখানে বন্দিপুর অভয়ারণ্য আছে, যেখানে ক’দিন আগেই মোদিজিকে কাউবয় হয়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল, সেই অঞ্চলে মোট আসন আছে ৫৫টা। সমীক্ষা বলছে বিজেপি পেতে পারে মাত্র ৩–৭টা, কংগ্রেস ২১–২৫টা, জেডিএস ২৫–২৯টা। মাথায় রাখুন এই এলাকা ভোক্কালিগাদের এলাকা এবং এখানে মুসলমান জনসংখ্যা অনেক বেশি। এবার মধ্য কর্নাটকের সমীক্ষা, বিজেপি পেতে পারে ১২–১৬টা, কংগ্রেস ১৯–২৩, জে ডিএস ০–১। সমুদ্র তীরবর্তী কর্নাটকের সমীক্ষা বলছে বিজেপি ১৫–১৯, কংগ্রেস ৩–৫টা আসন পেতে পারে। এই অঞ্চলেই ওই হিজাব বিতর্ক হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণকে তীব্র করেছে। এবার মহারাষ্ট্র ঘেঁষা কর্নাটক অঞ্চলের সমীক্ষা যেখানে বাঙালিরা বেড়াতে যান, সেই একদা চালুক্য সাম্রাজ্য বাদামি অঞ্চলে, এখানে মোট আসন ৫০টা। বিজেপি পেতে পারে ২০–২৪, কংগ্রেস ২৬–৩০, জেডিএস ০–১টা আসন। এরপর হায়দরাবাদ ঘেঁষা কর্নাটকের সমীক্ষা, এখানে ৩১টা আসনের ৮–১২টা পেতে পারে বিজেপি, ১৯–২৩টা আসন পেতে পারে কংগ্রেস, জেডিএস ০-১টা আসন পেতে পারে। তাহলে মোট ছবিটা এইরকম— বিজেপি ৭৪–৮৬, কংগ্রেস ১০৭–১১৯, জেডিএস ২৩–৩৫টা আসন। মানে সি ভোটারের সমীক্ষায় কংগ্রেস এগিয়ে থাকলেও দোলাচল আছে, কিন্তু বিজেপির অবস্থা যে খারাপ তা পরিষ্কার। কিন্তু এই কর্নাটক বিজেপির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দক্ষিণে এটাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য রাজ্য যেখানে বিজেপি আছে, এখানেও হেরে গেলে দক্ষিণ ভারত বিজেপি-মুক্ত দক্ষিণ ভারত হতে সময় নেবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে এই কর্নাটকের ভোটের পরেই আসছে তেলঙ্গনা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর রাজস্থানের নির্বাচন। কংগ্রেসের কাছেও এই নির্বাচনে জেতাটা খুব দরকার। কর্নাটকে জিতলে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা সেই অর্থে নির্বাচনী সাফল্যকে ছুঁতে পারবে, এবং অবশ্যই এর পরের নির্বাচনগুলোতে কংগ্রেস এক্সট্রা অক্সিজেন পাবে। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষা আর কর্নাটক থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে আমরা জোর দিয়েই বলছি অ্যাডভানটেজ কংগ্রেস। কর্নাটকে হাওয়া কংগ্রেসের দিকেই বইছে। কোনও প্রজাতির শাখামৃগর পক্ষে এই হাওয়া ঘোরানো অসম্ভব।