একজন ছাত্র যে এই বাজারে বাংলা পড়তে এসেছিল মেদিনীপুর থেকে, জীবনানন্দ থেকে সুনীল নিশ্চয়ই তাকে টেনেছিল, মানিক থেকে কমলকুমারের কিছু তো সে পড়েছিল নিশ্চয়ই। আর দশজনের মতো সেও তো নিশ্চয়ই শুনেছিল বাংলায় এমএ পাশ করে চিড়িয়াখানায় ভাল্লুক সাজতে হওয়ার সেই পুরনো কাহিনি। তবু সে চেয়েছিল বাংলা পড়তে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল সে। আপাতত লাশকাটা ঘরে ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে সে, নাকি সেসব পাট চোকার পরে ছাই হয়ে গিয়েছে, জানি না, জানার ইচ্ছেও হয়নি। কিন্তু জানি তার নগ্ন দেহ পড়ে ছিল, রক্ত ঝরছিল দেহ থেকে। শোনা যাচ্ছে, কেউ কেউ যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ঠিক তখনই কেউ কেউ পুলিশ আসলে কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে তা নিয়ে বৈঠক করছিল। প্রায় পরিষ্কার এটা যে এটা সেই পরিচিত র্যাগিংয়ের ক্লাইম্যাক্স, যেখানে ছেলেটি অত্যাচারে মারা যায় বা অত্যাচার না সইতে পেরে আত্মহত্যা করে। পুলিশ তদন্ত করছে, রাজ্য সরকার হাত তুলে নিয়েছে, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আচার্য তো রাজ্যপাল, তিনিই বলুন কী হয়েছিল। কথাটা আংশিক সত্যও বটে, সেই মহামহিম আনন্দ বোস ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু আপাতত চুপ। মাস্টারমশাইদের মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে ওঁরা দেবশিশু, সবে জন্ম নিয়েছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে র্যাগিং হয়, হত তা তাঁরা জানতেনই না, তাঁদের কেউ কেউ ভাষার আড়ালে মুখ লুকোচ্ছেন। কিন্তু এসব তো স্বাভাবিক, যা স্বাভাবিক নয় তা হল যাদবপুরের নীরবতা। রাজ্য কেন গোটা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া যত কিছুর প্রতিবাদ তো এখানেই শুরু হয়, মিছিল নগরীর ছিটেফোঁটা ঐতিহ্য যা বেঁচে আছে তা তো এই যাদবপুরেরই জন্য। তাহলে সেই যাদবপুরে কলরব নেই কেন? নীরব কেন যাদবপুর? সেটাই বিষয় আজকে, প্রতিবাদ কোথায় কমরেডস? রাস্তায় নামুন।
আজ নয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদের কেন্দ্র হয়ে থেকেছে সেই কবে থেকে। কেবল শিক্ষা নয়, ছাত্র স্বার্থ নয়, যে কোনও সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে যাদবপুরের ছেলেমেয়েরা প্রতিবাদ করেছে, তাদের প্রতিবাদ দেখেছে মানুষ এমনকী জরুরি অবস্থার সময়ে। তারা প্রতিবাদ করেছে বাম, ডান যে কোনও সরকারের বিরুদ্ধে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময় তো সরকার পক্ষের কেউ কেউ, বামফ্রন্টের নেতারা অনেকেই বলতেন ওটা তো বহিরাগতদের আন্দোলন, ওটা তো যাদবপুরের ছেলেমেয়েদের কাজ। সেই যাদবপুর চিরটাকালই বামেদের দখলে, সরকারি বাম মানে এসএফআই দখল করত আর্টস ফ্যাকাল্টি, ভিন্ন ধারার বামেদের হাতে ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি, মোটামুটি এরকমই চলত। এনআরসি-সিএএ আন্দোলনের সময়েও যাদবপুর এগিয়ে ছিল মিছিলে মিটিংয়ে প্রতিবাদে। সে হেন যাদবপুরের কলরব স্তব্ধ কেন? একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে খুন করা হল, বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হল, তার স্বপ্ন অধরা রয়ে গেল, আজ কলরব নেই কেন? আজ মোমবাতি বা মশাল মিছিল নেই কেন? ঠিক কোথাটায় আটকাচ্ছে?
আরও পড়ুন: Aajke | রাজ্যপালের রাজা হওয়ার ইচ্ছে
সবচেয়ে বড় কথা এই ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকে, দায়িত্ব নিয়ে বলছি, প্রত্যেকে ভালো করেই জানতেন ইন্ট্রো দেওয়ার নাম করে যা চলে তা বিশুদ্ধ র্যাগিং। তাঁরা ভালো করেই জানেন কী ধরনের র্যাগিং চলে, কারা চালায়, কারা মদত দেয়, সবটা, সবটা জানতেন। জানতেন বলে চুপ করে আছেন? নাকি জড়িত বলে চুপ করে আছেন? কারা ছাত্র নয়, কারা পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে দেওয়ার পাঁচ, সাত, দশ বছর পরেও বোর্ডিংয়ে থাকে? কেন থাকে? কোন অধিকারে থাকে? কেউ জানে না? কোনও অধ্যাপক এই খবর জানেন না, ওখানকার সেই সব ছাত্রদরদি আহা উহু শিক্ষকেরা এখন মুখ বন্ধ করে বসে আছেন কেন? যাঁদের সঙ্গে এই অ-ছাত্র বোর্ডারদের দারুণ সম্পর্ক? এ এক দারুণ তামাশা। ওই যাদবপুরের পিওন থেকে ছাত্র, অশিক্ষক কর্মচারী থেকে শিক্ষক অধ্যাপকেরা, সব্বাই যা জানেন, আজ তা নাকি ভয়ঙ্কর রহস্য, চ্যানেলে চ্যানেলে বাইটে তাঁরা বলছেন দুঃখুর কথা, চোখ ভিজে, কিন্তু সত্যিই কি তাঁরা জানতেন না, এটা আমাদের মানতে হবে? সেই অতিবাম ছাত্রের দল, যাঁরা ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সরব, সরব হওয়াই উচিত, সেই তাঁরা হিরণ্ময় নীরবতায় ডুবে গেছেন এই মৃত্যুর ঘটনায়। হোক কলরব বলে যাঁরা এইটবি বাস স্ট্যান্ডে প্রায় স্বায়ত্ত শাসন এনে ফেলেছেন তাঁদের মুখে রা নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক নয়, এটা অপরাধ, ওই একই অপরাধের শরিক তাঁরাও যে অপরাধের ফলে এক কিশোরকে মরে যেতে হল। আমরা প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের দর্শকদের, যে ছাত্ররা কথায় কথায় রাস্তায় নেমেছেন মিছিল করেছেন, অবস্থানে বসেছেন, সেই ছাত্রদের কলরব আজ স্তব্ধ কেন? যাদবপুরের বাম অতিবাম ছাত্ররা এখনও রাস্তায় নেই কেন? তাঁরা এই র্যাগিং আটকানোর চেষ্টা করেননি কেন? শুনুন মানুষজন কী বলছেন?
একটা মৃত্যু অনেক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়। র্যাগিং এক ধরনের মানসিক অসুখ, এক ধরনের হেরে যাওয়া ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকেই এর জন্ম। ছাত্রদের মধ্যেই এটা জন্মায় কেন? বিশেষ করে সেই সব প্রতিষ্ঠানেই যেখানে সত্যিই ভালো ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করতে যান। এসব গবেষণার বিষয়। আর র্যাগিং থামানোর জন্য দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের নজরদারি, তাঁদের কাউন্সিলিং, তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাই পারে র্যাগিং আটকাতে। যাঁরা র্যাগিং করেন তাঁরাও ছাত্র, কাজেই তাদের ফাঁসি দিয়েও তো সমস্যার সমাধান হবে না। সেগুলোও ভাবা হোক। সরকারের দায় আছে বইকী, তাঁদেরও সক্রিয় হতে হবে, মৃত্যুর পরে নয়, মৃত্যু হওয়ার আগেই। কিন্তু আজ প্রশ্ন তা নিয়ে নয়, আজ প্রশ্ন নিজেদের কাছে, প্রতিবাদের স্রোতে যদি ভাটা আসে, প্রতিবাদ যদি সিলেকটিভ হয়, এক নৃশংস কাজে যদি এতটুকুও সমর্থন থাকে তাহলে তা অপরাধ, ক্ষমাহীন অপরাধ।