ন্যাশনাল কাউন্সেল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং, সংক্ষেপে এনসিইআরটি, এই সংস্থাই দেশের এক বিরাট অংশের সেকেন্ডারি এবং হায়ার সেকেন্ডারি শিক্ষার সিলেবাস তৈরি করে। এদেরই দেখরেখে বই ছাপা হয়, পাঠ্যক্রম থেকে পরীক্ষা ইত্যাদি হয়। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মোটের ওপর বড়লোকদের, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে আমার মনে হয় না। তার ওপরে আমরা জানি যে কী বিশাল নিরক্ষরতা আর অজ্ঞানতার বোঝা এই দেশ বয়ে নিয়ে চলেছে। আধুনিক মানুষ গুগল ইনস্টাগ্রামের সঙ্গেই সূর্যগ্রহণের সময় জলও ছোঁয় না, এখনও পরীক্ষার আগে দই চন্দনের ফোঁটা না নিয়ে হলে ঢোকে না। এমনকী আমি এমবিবিএস ডাক্তারবাবুকেও দেখেছি প্রেসক্রিপশন দেওয়ার আগে সামনে রাখা ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে রোগীর হাতে দিতে, ইঞ্জিনিয়ারকে দেখেছি ভিতপুজো করতে আর দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন মন্ত্রী আমলা, বিভিন্ন প্রফেশনের মানুষের মধ্যে দেখেছি কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকার। বিজ্ঞান পড়ার পরে অপবিজ্ঞান যাঁরা মানেন তাঁরাই ইতিহাস পড়ার পরেও অনৈতিহাসিক চর্চায় মগ্ন থাকবেন, এ আর নতুন কী? তারই মধ্যে শোনা গেল ইতিহাসের সিলেবাসে বেশ কিছু জায়গা বাদ দিচ্ছে এনসিইআরটি। খোঁজ নেওয়ার পরে তাঁরা জানালেন যে ছাত্রদের ব্যাগের ওজন বেড়ে যাচ্ছে, কোভিড ইত্যাদির সময়ে স্কুলও বন্ধ ছিল, তাই খানিক সিলেবাসের ভার কমানোর জন্য কিছু জায়গা বাদ দেওয়া হয়েছে।
বইয়ের ভার কমানো? বেশ তো, তাহলে কত কমল? মানে কত পাতা কমল? অঙ্কের বই থেকে ওই বাঁদরের ওঠানামার অঙ্ক কমল কি? কিংবা চৌবাচ্চার ফুটোর সেই বিভীষিকা, জল ভরছে জল বের হচ্ছে? নাকি সেই গরুর দুধে জল ঢেলে দাম বাড়িয়ে লাভ লোকসানের বেনিয়াগিরি? বাদ পড়েছে? না, ওসবে হাত পড়েনি। হাত পড়েছে সোশ্যাল সায়েন্স আর ইতিহাসে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, মোদিজির স্বপ্ন
আসুন দেখা যাক সেখানে কী কী বাদ পড়েছে। ক্লাস সেভেনের ইতিহাস বই, তার তিনটে পাতা উধাও, কী ছিল তাতে? দিল্লি সুলতান শাসনে মানে মামলক, খিলজি, লোদি, তুঘলকদের দাক্ষিণাত্য অভিযান, হুউউস করে ভ্যানিস। মজার কথা হল এই বাদ পড়া অংশতে বোঝানো আছে যে মসজিদ কাকে বলে? বাদ পড়েছে মুঘল শাসনের প্রাপ্তির কথা, তাজমহল থেকে ফতেপুর সিক্রি, লালকেল্লা থেকে আগ্রার দুর্গ, এসব প্রাপ্তির কথা ভ্যানিস। ক্লাস টুয়েলভ হিস্ট্রি টেক্সট বই থেকে বাদ পড়েছে কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস অধ্যায়, যেখানে আকবর নামা, বাদশাহ নামার মতো বইয়ের সারসংক্ষেপ পড়ানো হত। মুঘল দরবারে কেমন ছিল, বিচার ব্যবস্থা, তাদের অর্থনীতি কেমন ছিল, তাদের শিকার অভিযান, তাঁদের বিশাল বিশাল ইমারত গড়ে তোলার কাহিনি ইত্যাদি পড়ানো হত, আপাতত তা ভ্যানিস। ধরুন অধ্যায়টার নাম ছিল দ্য মুঘল এমপায়ার। ১৬ শতাব্দী থেকে ১৮ শতাব্দী, সেখানে এমপায়ার কথাটা তুলে নেওয়া হল, লেখা হল মুঘলস। স্রেফ মুঘলস, অথচ আগেই পড়ানো হয়েছে দ্য মৌর্য এমপায়ার, এর মানে কী? এমপায়ার কথাটা বাদ দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের কতটা ওজন কমানো যাবে? এই চ্যাপ্টারেই আকবর যে সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন বই ফারসিতে অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন, সেটা ভ্যানিস হয়ে গেছে। চ্যাপ্টারের নাম ছিল দ্য ডেলহি সালটানেটস, ১২ থেকে ১৫ শতাব্দী, সেই চ্যাপ্টারের এখনকার নাম ডেলহি। দ্য কাটা গেছে, সালটানেটস ভ্যানিস। বুঝুন সুলতান শব্দটাতে কত ঘেন্না এনাদের। তাই সুলতান মামুদ গজনি যিনি ১৭ বার সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিলেন তাঁর নাম থেকে সুলতান কথাটা তুলে দেওয়া হল এবং জোড়া হল এই লুঠের পেছনে ছিল ধর্মীয় কারণ। গজনি থেকে নাদির শাহ থেকে ব্রিটিশ তো মুঘলদের মতো এদেশে বসবাস করতে আসেনি, লুঠপাট করতেই এসেছে। এদেশ থেকে মুঘলদের ময়ূর সিংহাসন তুলে নিয়ে গেছে, কোহিনুর লুট করে নিয়ে গেছে। এর পেছনে ছিল সম্পদ বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা। এই সব রাজা রাজড়া নবাব সুলতানেরা যুদ্ধে যেতেন রাজত্বের পরিধি বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়াতে নাহলে লুঠ করতে। কাজেই আমরা এক মুসলিম নবাবের সঙ্গে আরেক মুসলিম বাদশাহের লড়াই দেখেছি, এক রাজপুতের সঙ্গে আরেক রাজপুতেরও লড়াই দেখেছি। কাজেই এই লুঠের পেছনে ধর্মীয় কারণ ছিল বলে দেওয়াটা অনৈতিহাসিক। তবে এটা তো সত্যিই যে অনেক মুসলমান নবাব সুলতান বা অনেক রাজপুত রাজা রাজড়ার মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল, সেই গোঁড়ামি থেকে ঘৃণা উদ্রেক হত বইকী। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যে বিভেদ তৈরি করে, এ আর নতুন কী? তো এই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস মুছে ফেলার আয়োজন। এ দর্শন তো আরএসএস-বিজেপির, তারা সেই দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে এটা খুব অস্বভাবিক কিছু নয়, তবে কয়েকটা চ্যাপ্টার মুছে দিয়েই তো ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, তা সম্ভবও নয়।
এবারে অস্কার পেল অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, এক যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের। লেখা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, এক জার্মান কিশোর সে যুদ্ধে যেতে আগ্রহী, তার বন্ধুদের সঙ্গে তার যুদ্ধে যাওয়ার উন্মাদনা আর কিছুদিন পর থেকেই সেই যুদ্ধের নৃশংসতা দেখে ক্লান্ত সেই কিশোরের গল্প, যে নিজেও শেষে মারা যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে যখন যুদ্ধ শেষের ঘোষণা হচ্ছে। এই বইটা হিটলার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পোড়ানো হয়, নির্দেশ দেওয়া হয় যেন এক কপিও কোথাও পড়ে না থাকে। কার্ল মার্কস, ফ্রয়েড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মনীষীর লেখার সঙ্গে নাৎসিরা অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট পুড়িয়ে ফেলে। তারপর? নাজি বাহিনী পরাজিত হয়, হিটলার আত্মহত্যা করে, বই পোড়ানোর নির্দেশ দেওয়া প্রাপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলস স্ত্রী-বাচ্চা সমেত আত্মহত্যা করে। সে বই আবার ছাপানো হয়, দু’ দুবার ছবি আর টিভি সিরিয়াল হওয়ার পরেও আবার ২০২২-এ ছবি হয়, তা এবার অস্কার পায়। বই টিকে আছে, ইতিহাস মোছা যায় না, তবুও ইতিহাস মোছার চেষ্টা অনেকেই করে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপির ৪৪-এ পা, মোদিজির ভাষণ
এখানেই থেমেছে নাকি এনসিইআরটি? না, মুছে ফেলার আরও কদর্য নমুনা আছে। আরএসএস–বিজেপির টার্গেট গান্ধীজি, কাজেই এনসিইআরটি সোশ্যাল সায়েন্সে গান্ধী চ্যাপ্টারেও হাত দিয়েছে, মুছেছে এই লাইন, He (Gandhi) was particularly disliked by those who wanted Hindus to take revenge or who wanted India to become a country for the Hindus, just as Pakistan was for Muslims… যারা চেয়েছিল ভারতবর্ষ কেবল হিন্দুদের হোক বা যারা চেয়েছিল পাকিস্তান কেবল মুসলিমদের হোক, তারা গান্ধীজিকে পছন্দ করত না। এই লাইনও মোছা হয়েছে, His steadfast pursuit of Hindu-Muslim unity provoked Hindu extremists so much that they made several attempts to assassinate Gandhiji… গান্ধিজী যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলছিলেন তাতে ক্ষুব্ধ হিন্দু উগ্রপন্থীরা গান্ধীজিকে মারার চক্রান্ত করে। আরও মোছা হয়েছে, Gandhiji’s death had an almost magical effect on the communal situation in the country… The Government of India cracked down on organisations that were spreading communal hatred. Organisations like the Rashtriya Swayamsewak Sangh were banned for some time… গান্ধীজির মৃত্যু ম্যাজিকের মতো থামিয়েছিল হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা। সরকার ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এমন সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকের মতো সংগঠনকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ক্লাস টুয়েলভ-এর বই থেকে নাথুরাম গডসের আগে ‘a Brahmin from Pune’ এবং ‘the editor of an extremist Hindu newspaper who had denounced Gandhiji as an appeaser of Muslims’ এই শব্দগুলোও মোছা হয়েছে।
ভাবছেন কেবল স্বাধীনতার আগের ইতিহাস নিয়েই এমন ছেলেখেলা হয়েছে? না তাও নয়, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা, যে সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। যে সময়ে বিরোধীদের জেলে পোরা হয়েছিল, সেই সময়ের ইতিহাস, জরুরি অবস্থার ইতিহাস বাদ পড়েছে। বাদ পড়েছে গুজরাত রায়টের কথা, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা, যেখানে নরেন্দ্র মোদির দিকেই এই সেদিনেও আঙুল তুলেছে বিবিসির মতো সংবাদ সংস্থা, সেই গুজরাত রায়ট ভ্যানিস, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যানিস হয়েছে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সেই অ্যাডভাইস, যা তিনি সেদিনের মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন, রাজধর্ম পালন করো। হ্যাঁ, সেই কথাটাও ভ্যানিস করে দেওয়া হয়েছে। আসলে নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানি ভারতবর্ষের এক নতুন ইতিহাস রচনা করার চেষ্টা করছেন, দেশে দেশে প্রত্যেক স্বৈরশাসক এই চেষ্টা করেন, মধ্যযুগের রাজারা করেছেন, সুলতান নবাবরা করেছেন, হিটলার মুসোলিনী তোজো করেছেন। গোয়েবলস তো ইতিহাসের অধ্যাপকদের ডেকে ম্যাপ দেখিয়ে বলেছিলেন অস্ট্রিয়া, পোলান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এমনকী ফ্রান্স, এগুলোও জার্মানি, এবার সেই জার্মানির ইতিহাস লিখুন। সে ইতিহাস কেউ মানেনি, আজ নরেন্দ্র মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে এক নতুন ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু এ ইতিহাসও থাকবে না। যদিও ইতিহাসে এই অপচেষ্টার কথা কিন্তু লেখা থাকবে, বলা থাকবে যে এক স্বৈরাচারী শাসক ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, সফল হননি।