বিহার, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা, ওড়িশা, হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশের ৭টি আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল, ফলাফলও আমাদের হাতে। চারটি আসনে বিজেপি জিতেছে, একটি করে আসন জিতেছে আরজেডি, শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে গ্রুপ এবং তেলঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি। সমবেত হুক্কা হুয়া মানে ওই গোদি মিডিয়া উল্লসিত, তাদের প্রভুদের চেয়ে ঢের বেশি উল্লসিত তারা। আসুন একটু আলোচনা করা যাক এই উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে। এই সাতটা আসনের মধ্যে কংগ্রেসের হাতে ছিল একটি আসন, সেটা খোয়া গেছে। বিজেপির হাতে ছিল বিহারের গোপালগঞ্জ, ওড়িশার ধামনগর, উত্তরপ্রদেশের গোলা গোরখনাথ, তারা আসনগুলো জিতেছে। শিবসেনার হাতে ছিল আন্ধেরি ইস্ট, ভাঙনের পরেও উদ্ধব ঠাকরে তা ধরে রাখলেন। আরজেডি-র হাতে ছিল মোকামা, টিআরএস-এর হাতে ছিল মুনুগোড় আসন, তা তারা ধরে রেখেছে। এটা হল ফলাফল। আসুন রাজ্য আর আসন ধরে এই ফলাফলকে বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমেই আসুন মহারাষ্ট্রের আন্ধেরি ইস্ট আসনে। শিবসেনার এমএলএ রমেশ লাটকে মারা যাওয়ার পরে এই আসন খালি হয়, এর মধ্যেই শিবসেনার ঐতিহাসিক ভাঙন। রমেশ লাটকের স্ত্রী রুতুজা লাটকেকে এই আসন থেকে লড়ার টিকিট দেন উদ্ধব ঠাকরে, এটাই ছিল মাস্টার স্ট্রোক, সহানুভূতি ভোটের সঙ্গে এনসিপি আর কংগ্রেসের ভোট মিলে জেতার ঠিকঠাক ইকুয়েশন। বিজেপি আসনে প্রার্থী ঠিক করার পরে বুঝতে পারল এমনকী শিবসেনার শিন্ডে গ্রুপের সমর্থন থাকলেও জেতা অসম্ভব, সদ্য শিবশেনা ভাঙার পরে এই হার মুখ পোড়াবে। তারা সাত পাঁচ হিসেব করে সরে দাঁড়াল, মুখরক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন আরেক ঠাকরে, রাজ ঠাকরে। তিনি অনুরোধ করলেন একদা বাল ঠাকরে ঘনিষ্ঠ শিবসৈনিক রমেশ লাটকের বিধবা স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিতে, ওমনি বিজেপি প্রার্থী সরিয়ে নিল। সেদিনই পরিষ্কার ছিল ভোটের ফলাফল। কিন্তু দেখার মতো ব্যাপার হল উদ্ধব ঠাকরে গোষ্ঠী পেয়েছে ৭৬.৮৫ % ভোট। অনেকেই এমন ছিলেন যাঁরা বিজেপি বা শিন্ডে গোষ্ঠীর সমর্থক, তাঁরা নোটাতে ভোট দিয়েছেন, নোটার ভোট ১৪.৭৯ %। শিবসেনাকে ভাঙা গেছে বটে কিন্তু মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি কিন্তু একেবারে শক্তিহীন হয়নি, এবং ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-শিবসেনার ফলাফল কোনও ভাবেই ২০১৯কে ছুঁতে পারবে না। ২০১৯-এর ফলাফল কী ছিল? সেবার বিজেপি শিবসেনা জোট একসঙ্গে লড়েছিল, ৪৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি ২৩টি, শিবসেনা ১৮টি, এনসিপি ৪টি, কংগ্রেস ১টি এবং আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম ১টি আসন পেয়েছিল। এবার শিবসেনা ভেঙেছে, আর অন্যদিকে এনসিপি, কংগ্রেস, শিবসেনা উদ্ধব গোষ্ঠী একসঙ্গে লড়বে। বিজেপি জোট খুব ভাল লড়লেও এখানে গোটা ১০/১২ আসন খোয়াবে। এবার চলুন হরিয়ানায়, দেশে সামন্ততন্ত্র আছে, সেটা বোঝার জন্য হরিয়ানায় চলে যান, নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংবিধান এসব কৌন চিড়িয়া কা নাম হ্যায়? ধরুন হিসারের আদমপুর, ভজনলালের রাজনৈতিক আখড়া, সেখানে অন্য কেউ জিতবে কী করে? সেখানে ভাব্য বিষ্ণোই বিজেপির প্রার্থী জিতেছেন। কে ইনি? ভজনলালের নাতি, কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের পুত্র। এই আসন ছিল কংগ্রেসের হাতে, এমএলএ ছিলেন কুলদীপ বিষ্ণোই, তিনি বিজেপিতে চলে আসেন, এবার সেই আসনেই পুত্রের অভিষেক। হোক না বিজেপি থেকে, জিতেছেন ভাব্য বিষ্ণোই। কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়ালেও জিততেন। হারিয়েছেন কাকে? কংগ্রেস প্রার্থী জয় প্রকাশকে। মজার ব্যাপার হল এই জয় প্রকাশ একবার ভজনলালের বিরুদ্ধে লড়েছেন, হেরেছেন, কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন, হেরেছেন। এবার ভব্য বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে লড়লেন, হারলেন। এই আসনের ফলাফল দিয়ে আগামী নির্বাচনের ফলাফল বোঝা যাবে না। এটা ভজনলালের আসন, তাঁর পরিবারের কেউ এখান থেকে হারবে না, এটাই হরিয়ানা। এবার চলুন হাই ভোল্টেজ আসন, তেলঙ্গানার মুনুগোড়ে। আসন ছিল টিআরএস-এর কাছে, টিআরএসই রেখেছে। কিন্তু এর আগে কংগ্রেস ছিল বিরোধী দল, এবার সেই জায়গায় উঠে এসেছে বিজেপি। টিআরএস বিজেপি নিয়ে দোদ্যুল্যমানতা কাটিয়ে বছর কয়েক ধরে যে তীব্র বিজেপি বিরোধী হয়ে উঠেছে, তার কারণ হল কংগ্রেস নয়, তেলঙ্গানায় খুব দ্রুত বিজেপি হয়ে উঠছে দ্বিতীয় দল। মাথায় রাখুন রাহুল গান্ধী পদযাত্রা করছেন, তেলঙ্গানাতেও ছিলেন ভোটের আগেই। কিন্তু কংগ্রেস তিন নম্বরে, অবশ্য আরও কিছু ভোট কাটলে টিআরএস-এর কপালে বিপদ ছিল। কংগ্রেস প্রায় ২৪ হাজার, ১০ % ভোট পেয়েছে। অতএব আগামী তেলঙ্গানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে এই কংগ্রেস কতটা ভোট কাটবে, তার ওপরে নির্ভর করবে টিআরএস বা বিজেপির জয়পরাজয়। কংগ্রেস ১৭-২০ % ভোট পেলে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসবে, এটাই বিজেপির হিসেব, টিআরএস ঠিক তাই লড়াইটাকে তীব্র মেরুকরণের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করে চলেছে। কংগ্রেস নয়, আপাতত তার আক্রমণ বিজেপির বিরুদ্ধে। এবার দেখা যাক ওড়িশার ধামনগরের ফলাফল। এখানে বিধায়ক ছিলেন বিজেপির বিষ্ণুচরণ শেঠি, ২০০৯, ২০১৪ তে বিজেডির কাছে হেরেছিলেন, ২০১৯ এ বিজেডিকে হারিয়েছিলেন, ২০২২ এ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিজেপি দাঁড় করায় তাঁর পুত্র সূর্যবংশী সুরযকে, তিনি জিতেছেন। এক নির্দল প্রার্থী রাজেন্দ্রকুমার দাস আট হাজারের বেশি ভোট কেটে নেওয়ায় তাঁর জেতার রাস্তা সহজ হয়েছে। ওড়িশাতেও বিজেপির উত্থান বিজেডিকে ক্রমশ বিপন্ন করে তুলছে। নবীনবাবু যতদিন আছেন, ততদিন তো সামলে নেবেন, কিন্তু তারপর এ রাজ্যে কংগ্রেসের উত্থান নিশ্চিত। মানে ওড়িশা আবার কংগ্রেস বিজেপি লড়াইয়ে ফিরবে। শেষ রাজ্য বিহার, রাজনীতির শেষ কথা, যেখানে সর্বভারতীয় রাজনীতির নানান এক্সপেরিমেন্ট চলতেই থাকে। বিহারে দুটো আসনে নির্বাচন হয়েছে, মোকামা আর গোপালগঞ্জ। মোকামায় নির্বাচন হল কেন? এর আগের এমএলএ আরজেডির বাহুবলী অনন্ত সিংয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস সিনেমার মতো। ২০০৫-এ তিনি জেডিইউ-র টিকিটে এই মোকামা থেকে জেতেন, ২০১০ এও লোকজনশক্তি পার্টির সোনম দেবীকে হারিয়ে আবার বিধায়ক হলেন। ২০১৫তে তিনি জেডিইউ ছাড়লেন, কেন? কেননা নীতীশ কুমার আরজেডির সঙ্গে মহাগঠবন্ধন করেছেন। তো নীতীশ কুমারের সরকার তৈরি হল। অনন্ত সিংয়ের বিরুদ্ধে ৭টা হত্যা, ১১টা হত্যার চেষ্টা আর ৪টে অপহরণের মামলা ছিলই, তার সঙ্গে পাওয়া গেল একে ৪৭ রাইফেল, ১৬ আগস্ট ২০১৯-এ সুশাসন বাবু নীতিশ কুমারের সরকার ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করল অনন্তকুমার সিংকে। জেলে পোরা হল, ২০২০তে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের টিকিটে তিনি মোকামা থেকে জিতলেন, কিন্তু আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ হল। অতএব বাই ইলেকশন, এদিকে নীতীশ কুমার হাত ধরেছেন আরজেডির, মোকামা আসনে আরজেডি দাঁড় করাল বাহুবলী অনন্ত সিংয়ের স্ত্রী নীলম দেবীকে, তিনি অনায়াসেই জিতেছেন। কিন্তু উল্টোদিকে কে? মানে বিজেপি কাকে দাঁড় করিয়েছিল? আরেক প্রবল প্রতাপ বাহুবলী লল্লন সিংয়ের স্ত্রী সোনম দেবীকে। টক্কর দুই বাহুবলীর, সামনে নির্বাচনের ময়দানে তাঁদের স্ত্রী নীলম দেবী, সোনম দেবী, এই লল্লন সিং, কুখ্যাত মাফিয়া সুরযভান সিংয়ের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন, লোকজনশক্তি দলে ছিলেন, এখন বিজেপিতে। বিহার বিহারেই আছে। অন্য বাই ইলেকশন হয়েছে গোপালগঞ্জে। এখানে জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী কুসুম দেবী, তিনি হলেন আগের বিধায়ক সুভাষ সিংয়ের স্ত্রী। এই সুভাষ সিং ২০০৫ থেকে বিজেপির হয়ে লাগাতার জিতে চলেছেন, ২০২০তে জিতে নীতীশ মন্ত্রিসভার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ২০২২-এ মারা যাওয়ায় এই আসনে নির্বাচন হল। কিন্তু জেতার পেছনের গল্প হল ভোট কাটার গল্প। আসাদউদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম ১২২১৪টা ভোট কেটেছে, আর বহুজন সমাজবাদী পার্টি দাঁড় করিয়েছিল লালু যাদবের শ্যালক, তেজস্বী যাদবের মামা সাধু যাদবের বউ ইন্দিরা যাদবকে, যিনি ৮৮৫৪ ভোট কেটেছেন। আরজেডি প্রার্থী হেরেছেন ১৭৯৪ ভোটে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কপালে শনি নাচছে, গোপালগঞ্জে এই কোনওরকমে জয় বলে দিচ্ছে সেই কথা। ২০১৯-এ বিহারে বিজেপি জিতেছিল ১৭টা আসন, জেডিইউ ১৬টা, লোকজনশক্তি পার্টি ৬টা আর কংগ্রেস ১টা। এবার বিহারে বিজেপি আর শরিকদল মিলে ৪-৫ টা আসন পেলেও বেশি পাওয়া হবে। আর উপনির্বাচন ছিল উত্তরপ্রদেশের গোলা গোরখনাথে, ওখানে বিজেপি জিতেছে, কিন্তু সমাজবাদী দল ভোট পেয়েছে ৪০ %, কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি, বিএসপি প্রার্থী দেয়নি। ইউপিতে ২০১৯-এ বিজেপি ৬২টা আসন, বিএসপি ১০টা, এসপি ৫টা, অপনা দল ২টো আর কংগ্রেস ১টা। বিজেপিও জানে এই ফলাফল সম্ভব নয়, এখানেও ৫/৭ টা আসন কমবে। কাজেই এই উপনির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিজেপির কোনও খুশখবর তো নেই-ই, বরং যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে।