আজকের বিষয়– ২০২৩ কেমন কাটবে দেশের মানুষের। সাধারণত এইরকম বিজ্ঞাপন দেখা যায় জ্যোতিষ বিজ্ঞাপনে, ইহাও হইবে, উহাও হইবে, এটিও ঘটিবে, সেটিও ঘটিবে। ভালো কিছু চাইলে আমার কাছে আসুন, স্বল্পমূল্যে প্রতিকারের জন্য। আপনি যদি সেই বিজ্ঞাপন দেখে সেই জ্যোতিষের চেম্বারে হজির হন তাহলে ২০২৩ আপনার কেমন কাটবে জানি না, কিন্তু এই ২০২৩ ওই জ্যোতিষীর যে ভালোই কাটবে তা বলা বাহুল্য। না, আমি ওই ভণ্ডামি সমর্থন করি না, তবুও আমার আজকের বিষয়, ২০২৩ দেশের মানুষের কেমন কাটবে? দেশের প্রধানমন্ত্রী যে অজস্র মিথ্যে কথা বলবেন, জতি নরসিঙ্ঘম বা স্বাধ্বী প্রজ্ঞা ইত্যাদিরা যে বিষ ছড়াবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি দফতর বিরোধী রাজনৈতিক নেতা শুধু নয়, সরকারের বিরোধিতায় সরব প্রত্যেক মানুষের বাড়িতে কড়া নাড়বে। বিজেপির উন্মাদ ভক্তের দল প্রতিটা জমায়েতে তাদের যুদ্ধ হুঙ্কার জয় শ্রীরাম নিয়ে হজির থাকবে এসব তো জানা কথা, দেশের প্রতিটি মানুষ তা জানেন। এক সংঘবদ্ধ জঙ্গি জাতীয়তাবাদী, উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস–বিজেপির নিশ্ছিদ্র সংগঠনের বিপরীতে বিরোধীদের তুই না মুই, মুই না তুই চলবে, এটাও জানা। কিন্তু বছরজুড়ে আম আদমির কেমন কাটবে? সে আপনি যত বড় বিজেপি আরএসএস ভক্তই হন না কেন, আপনাকে তো বাজারে যেতেই হবে, আপনার সন্তানদের হয় ব্যবসা করতে হবে, নাহলে চাকরি পেতেই হবে। বাস, ট্রাম, ট্রেনে চড়তে হবে, প্রয়োজনে ওষুধ কিনতে হবে, হাসপাতালে যেতে হবে, হবেই। আর ঠিক তাই দেশের অর্থনৈতিক মাপকাঠিগুলো দেখলেই বলে দেওয়া যায়, কেমন কাটবে আগামী দিনগুলো, কেমন কাটবে ২০২৩। সরকারের একটা হিসেব থাকে, বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ থাকে, কখনও সখনও সামান্য কম খরচ হয়, বেশিরভাগ সময়েই কিছু বেশি খরচ হয়। ২০২১-২২ এর বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৮.৮৩ লক্ষ কোটি টাকার, বছর শেষ হবার আগেই নতুন অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দের বিল পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী, এক রেকর্ড অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ, ৩.২৬ লক্ষ কোটি টাকার। কেন? দেখা যাচ্ছে, দ্রুতগামী ট্রেন, রাজধানীর নতুন পরিকাঠামো, প্রধানমন্ত্রী সমেত বিভিন্ন মন্ত্রী সান্ত্রীদের সুরক্ষা আর সরকারের বিপুল বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ উপচে গেছে, বরাদ্দের থেকেও বহুগুণ বেশি খরচ করা হয়েছে। ফোতো কাপ্তেন জমিদারবাড়ির লুচ্চা ছেলেদের খরচের মতোই এক বিষয়। তফাতটা কোথায়? এই ব্যয় বরাদ্দের বোঝা চাপবে আম আদমির ওপরে। আমি একে আরএসএস–বিজেপির আর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই বলব। নাদান কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু মাঝেমধ্যেই বলেন বাংলার সরকারের নাকি প্রচুর ধার, ঋণের ভারে ডুবে আছে সরকার। ঋণ নিয়ে লক্ষ্মীশ্রী, কন্যাশ্রী ইত্যাদি চলছে। নাদান খোকাবাবুর দেশের অর্থনীতির ব্যাপারে কিছুই জানা নেই, জানা নেই যে মোদি সরকারের বাজারে ধার গত সমস্ত সরকারকে কবেই ছাপিয়ে গিয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সরকার বাজার থেকে টাকা তোলেনি? তুলেছে। সেই ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। আর মোদি সরকার? ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে বাজার থেকে কত টাকা তুলেছে? ঋণের পরিমাণ ৮৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু একটু আগেই আমি বলেছি, এটা আরএসএস–বিজেপির অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। অটলবিহারী বাজপেয়ীয়ের জমানাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। ডেট টু জিডিপি রেশিও নামে এক হিসেব আছে, মানে কোন বছরে জিডিপি কত, আর তার সাপেক্ষে সেই বছরে সরকারের ঋণ কত? চলুন একটু সেই তথ্যের দিকে চোখ রাখি। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ বাজপেয়ী জমানা, ৯৯-এ ওই ডেট টু জিডিপি রেশিও ৭০.৪৭, মানে ১০০ জিডিপি হলে ৭০ টাকা ৪৭ পয়সা ঋণ, ২০০০-এ ৭৩.৬৭, ২০০১-এ ৭৮.৭৯, ২০০২-এ ৮২.৮৬, ২০০৩-এ ৮৩.২৩-এ গিয়ে দাঁড়ায়। ২০০৪-এ অটল বিদায়, মনমোহন সিংহ, একজন অর্থনীতিবিদের হাতে দেশ, ২০০৪-এ ডেট টু জিডিপি রেশিও ৮২.১৩, ২০০৫-এ ৭৯.০৭, ২০০৬-এ ৭৪.৬৬, ২০০৭-এ ৭১.৪৪, ২০০৮-এ সামান্য বেড়েছিল ৭২.২১, ২০০৯-এ ৭০.০৪ এসে ঠেকে। ২০১০-এ ৬৫.৬। এরপর থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই রেশিও ৭০-এর উপরে ওঠেনি। ২০১৪তে ডেট টু জিডিপি রেশিও ছিল ৬৬.২৩, ২০১৫তে ৬৮.৫৩, ২০১৬তে ৬৮.৭৭, ২০১৭ তে ৬৯.৫৭, ২০১৮তে ৭৩.৫১, ২০১৯-এ আবার নরেন্দ্র মোদি মসনদে, ডেট টু জিডিপি দাঁড়াল ৭৫.৩৩-এ, ২০২০ ৮৯.৪১, ২০২১-এ ৮৯.২৬। তথ্য কী বলছে? আরএসএস–বিজেপি জমানার অটল সরকারের সময়, পরে নরেন্দ্র মোদির সময়ে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে শুধু নয়, ক্রমাগত বেড়েছে, যা থেকে বলা যায়, ধার করে ঘি খাওয়াটা তাঁদের দর্শন। এই ধার করার ফলে হচ্ছেটা কী? সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরা, আর মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তরা। যাঁরা সরকারের দেওয়া ফ্রি রেশন পান না, কিন্তু বাজারের মার সহ্য করতে হয় তাদের, সিনিয়র সিটিজেনদের জমা পয়সার উপর সুদ ক্রমাগত কমতে থাকে, তাদের মূল আয় কমতে থাকে। বিরাট টাকা খরচ করে পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে, সেই পরিকাঠামোর সাহায্যে বেড়ে উঠছে ব্যক্তিগত পুঁজিতে গড়া শিল্প, আবার সে সব শিল্প যেহেতু শ্রম নির্ভর নয়, যন্ত্র নির্ভর, তাই চাকরিও বাড়ে না। ২০১৪তে বেকারত্ব ছিল ৪ শতাংশ, এখন ঠিক তার দ্বিগুণ ৮ শতাংশের ধারে কাছেই ঘোরাফেরা করছে, এবং এই বেকারত্বের হারও এক রেকর্ড। ৭ লক্ষ চাকরির জন্য ২২ কোটি দরখাস্ত জমা পড়েছে, সেই বেকার ছেলেদের কী বলা হবে? দেখো আমরা রামচন্দ্রের সবচেয়ে উঁচু মন্দির তৈরি করছি? দেখো মুসলমানদের তিন তালাক আইন আমরা বাতিল করেছি? দেখো আমরা সিএএ এনে দেশের সংখ্যালঘুদের টাইট দিয়ে দেব? দেখো আমরা হিজাব বন্ধ করছি? কী বলা হবে সেই সব সক্ষম যুবকদের? তাদের দুটো হাত কাজ চায়, সম্মানজনক, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি। বেকার ছেলেরা বছরের পর বছর অক্ষম জীবন কাটাবে আর প্রতিবছর বিভিন্ন পর্যায়ে ভোট দিতে দিতে গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর, গান গাইবে, তা তো হয় না। ২০২০-২১ এ গড় রোজগার কমেছে ৯১৬০ টাকা, হ্যাঁ আম্বানি আদানিদের রোজগার যখন প্রতি মিনিটে বেড়েই চলেছে, তখন আমাদের দেশের আম আদমির রোজগারের গড় কমেই চলেছে। আগামী বছর আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি কেমন হবে? সরকার, হ্যাঁ সরকার বলছে ৮ শতাংশ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক বলছে ৬ শতাংশ, ক্রিসিল বলছে ৬ শতাংশ, গোল্ডম্যান স্যাশ বলছে ৫.৩ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বলছে ৫.১ শতাংশ। আমরা এটাও জানি যে এর আগে নির্মলা সীতারামনের দাবি বাস্তবের সঙ্গে কোনও বছরেই মেলেনি। কেবল এটাই নয়, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর দিকে তাকান, কেবল হিন্দুত্বের স্লোগান দিতে থাকা মধ্যপ্রদেশ, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর আর কিছুদিন আগে থাকা বিহারের জিএসটি আদায়ের করুণ ছবি। ২০২১ জুলাই থেকে ২০২২ জুন পর্যন্ত মাথা পিছু জিএসটি আদায়ের তথ্য বলছে মধ্যপ্রদেশ ৩৮৯ টাকা, অসম ৩৫৭, উত্তরপ্রদেশ ৩৪২, মিজোরাম ২৪৩, নাগাল্যান্ড ২২২, ত্রিপুরা ১৯৬ টাকা, মণিপুর ১৬৫, আর এই সেদিন পর্যন্ত ডাবল ইঞ্জিনের নীতীশ-বিজেপি সরকারের জিএসটি আদায় ছিল মাত্র ১১১ টাকা। এবার চলুন কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়ে। সেখানে মাথা পিছু জিএসটি আদায় ৯৬৬, ঝাড়খণ্ড ৭১৯, কেরল ৬৯৮, পঞ্জাব ৬৪৪, রাজস্থান ৫২৫, পশ্চিমবঙ্গ ৫০৮ টাকা মাথা পিছু জিএসটি আদায় হয়। নাদান কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু এসব জানেন না, সকালে উঠে তিনি জনসভায় গিয়ে বলেন দেশ এগোচ্ছে আর বাংলা পিছোচ্ছে, নিজের রাজ্য পিছোচ্ছে বলতে বলতে তেনার চোখ মুখ চকচক করে।
মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেই এক এমপাওয়ার্ড অ্যাকশন গ্রুপ অফ স্টেট তৈরি করেছিল, তাতে আছে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর ওড়িশা। ৮টা রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা খুব খারাপ, তাই তাদের স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে এই ৮টা রাজ্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, এখন অবস্থাটা কী? এর সঙ্গে অসম জুড়ে নিন, ৯টা রাজ্যের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিশুমৃত্যু, শিশুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি অনুযায়ী জাতীয় গড়ের থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে। বাংলার অবস্থা সেই তুলনায় অনেক ভালো। তাহলে কেমন কাটবে ২০২৩? এই সমস্ত আর্থিক মাপকাঠিই বলে দিচ্ছে আম আদমি ২০২৩-এ ভালো কিছু প্রত্যাশা করতেই পারে না, মানে ভালো হবে না, কিন্তু আরও খারাপ হবে কী? রঘুরাম রাজন, প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর বলেছেন, সরকার তথ্য গোপন করছে, যার ফলে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সামনেই আসছে না, সরকার দাবি করছে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির, ২০২৩-এ বাস্তব বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ করাটাও এক বিরাট কাজ হবে। দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কমবে, আম আদমির অবস্থা আরও আরও খারাপ হবে, তবে একবারও মনে করবেন না যে এসবের ফলে আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লাদের সম্পদ কমবে বা ভারতবর্ষে নতুন বিলিওনেয়ার তৈরি হবে না, না এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। ২০২৩-এ আম্বানি আদানি ইত্যাদি কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের সম্পদ বাড়বে, রোজগার বাড়বে, কম করেও নতুন শ’ খানেক বিলিওনেয়ার জন্ম নেবে, আরও সংকুচিত হবে আম আদমির আয়, আম আদমির মোট সম্পদ।