কোয়ালিশন পলিটিক্স নিয়ে সবচেয়ে সরস গল্পটা বহুকাল আগের। জনতা পার্টির সরকার পড়ে গিয়েছে, ইন্দিরা আবার ক্ষমতায় আসার পরে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে মারা গিয়েছেন। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী, বোফর্স নিয়ে সরব বিরোধীরা, একধারে বিজেপি, অন্যধারে কমিউনিস্টদের একই স্লোগান, গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। রাহুল তখন টিন-এজার। সেই সময়ে সংসদে বলতে উঠে রাজীব বলছেন, কোয়ালিশন পলিটিক্স একটা খুব খারাপ আইডিয়া, এটা এক ধরনের সুবিধেবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন উল্টোদিকে বসে থাকা অন্যতম বিরোধী নেতা জর্জ ফার্নান্ডেজ বলেছিলেন, আপনার মাদার ইন ল, শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করুন, কোয়ালিশন পলিটিক্স আপনি যতটা বলছেন ততটাও খারাপ নয়। গোটা সংসদ সমেত রাজীব গান্ধীও হেসেছিলেন। সেই সময়ে ইতালিতে কোয়ালিশন সরকার চলছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রেই কেবল নয়, বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জোট হয়েছে। এই তো ভারত জাপান জোট বাঁধছে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জোট হয়েছিল। ক’দিন পরেই পৃথিবীতে যে দেশকে কমিউনিস্টরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বলে চিহ্নিত করবে, বা সেই সময়ের সবথেকে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেনের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল সোভিয়েত রাশিয়া, স্তালিন, রুজভেল্ট, চার্চিল জোট। এই জোটের কিছুদিন আগেই জোট বেঁধেছিল হিটলারের জার্মানি আর স্তালিনের রাশিয়া, অনাক্রমণ চুক্তি হয়েছিল। অতএব জোট মানেই কোনও আদর্শগত অবস্থান নয়।
আপাত লক্ষ্য পূর্ণ হওয়ার পরে জোট টিকেছে? সেটাও নয়। কিন্তু জোট হয়েছে, হচ্ছে, রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশে দেশে জোট সরকার চলেছে। সেই প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে আগের জোটগুলোর ফারাকটা কোথায়? বা আদৌ ফারাক আছে কি? যদিও জোট রাজ্যে রাজ্যে হয়েছিল, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে প্রথম সর্বভারতীয় জোট ছিল জনতা দলের। ইন্দিরা গান্ধী যদি জরুরি অবস্থা জারি না করতেন, তাহলে এই জোট হত? কোনওমতেই হত না। জগজীবন রাম আর জনসঙ্ঘের লালকৃষ্ণ আদবানির জোট সম্ভব ছিল না। এরপরের জোট সরকার বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের, একধারে বাম অন্যধারে রামের সরকার। উদ্দেশ্য কংগ্রেস হাটাও। এই একমাত্র উদ্দেশ্য ছাড়া এই জোট সম্ভব ছিল? না, বিজেপির নেতা অটলবিহারীর হাত ধরে জ্যোতিবাবুর এই সমর্থন এমনিতে অসম্ভব ছিল, কিন্তু ওই কংগ্রেস হাটাও, দেশ বাঁচাও, এই স্লোগান বাম আর রামেদের এক করেছিল। এরপরে অটলের জোট সরকার, উল্টোদিকে ইউপিএ, আবার উদ্দেশ্য ওই একই, অটলবিহারীর সরকার ফেলতে হবে, হয়েছিল ইউপিএ ১, ইউপিএ দুই। সেই প্রথম বাম-কংগ্রেস গলা জড়াজড়ি, কেন? ওই যে অটলবিহারী গদি ছাড়ো। এরপরে আবার কংগ্রেস হাটাও, ইউপিএ হাটাও। এনডিএ তৈরি হল, সমাজতন্ত্রী জর্জ নীতীশের সঙ্গে আদবানি, অটল, প্রমোদ মহাজন এক হলেন ওই কংগ্রেস হাটাও স্লোগানকে সামনে রেখে। এই ইতিহাস থেকে একটা কথা তো পরিষ্কার, দেশজুড়ে বিরোধীরা যখনই জোট বেঁধেছেন, যতবার বেঁধেছেন ততবারই সফল হয়েছেন, শর্ত একটাই বিরোধী প্রত্যেক দলকে জোটে আসতে হবে। এবং ৯০ থেকে সেই জোট দুটো অক্ষকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, দুই জোটের মধ্যমণি হয় কংগ্রেস না হলে বিজেপি। এবং আরেকটা খুব স্পষ্ট ঝোঁক যা এখনও পর্যন্ত এই দেশে এই জোটগুলো থেকে পরিষ্কার হয় তা হল আদর্শ ইত্যাদি বাওয়ালি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নির্বাচনে জয় ক্রমশ দূরে সরছে, মোদিজি নার্ভাস?
আদতে প্রত্যেক দল জোটে এসেছে তাদের নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করে, নিজেদের ক’টা আসন, কোন কোন মন্ত্রিত্ব, সামাজিক জোটের অবস্থান, গোদা বাংলায় জাতপাতের হিসেব দেখে তারপর শিবিরে যাওয়া বা শিবির বদল করা। কিন্তু এই ইতিহাসটা প্রি-মোদি এরা, মোদি যুগের আগে। মোদিজি আসার পরে ভারতের রাজনীতির এক গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, সেটা রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক দলের নেতাদের, সাংবাদিক, সচেতন মানুষজনের এমনকী এক বিরাট অংশের সাধারণ মানুষেরও বুঝতে দেরি হয়েছে। এক হুমদো টাইপের ভদ্রলোক, যিনি ফেসবুকে বিভিন্ন জ্ঞান বিতরণ করেন, তিনি ডিমনিটাইজেশনের পরে বলেছিলেন, ভারতের অর্থনীতি বদলে যাবে, এই প্রথম ভারত একজন সত্যিকারের নেতাকে পেল। তর্ক, যুক্তি, তথ্যের ধার দিয়েও গেলেন না, মোদিজি যা করেছেন তা ১০০ শতাংশ সঠিক। বেশিদিন নয়, মাস ছয়েক পরে তিনি বুঝতে পেরেছেন, কারণ এই ডিমনিটাইজেশন ওঁর ব্যক্তিগত রোজগারে প্রভাব ফেলেছিল, কাজ কমেছিল, আয়ও কমেছিল। ঠেলার নাম বাবাজি। মোদি-যুগ শুরু তো সেই ২০০২ থেকেই, কিন্তু সেদিন রাষ্ট্র, সরকার যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতো, তাহলে এই যুগের বাড়বাড়ন্ত হত না। কিন্তু বেশিরভাগ দল, দলের নেতারা সেদিন ওই তীব্র ঘৃণা ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক হিংসার কারখানাকে ইগনোর করেছিলেন, বুঝতেই পারেননি যে এই বিষ কতটা ছড়াতে পারে। না, কংগ্রেসও বুঝতে পারেনি, আর এদেশের সংসদীয় কমিউনিস্টদের বোধ নিয়ে তো কোনও প্রশ্ন করা অর্থহীন।
তো যাই হোক সেই মোদি যখন জাতীয় রাজনীতির সেন্টার স্টেজে উপস্থিত, তখন থেকে ধীরে ধীরে এক স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে সারা দেশে। একদিকে কিছু দল যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যকে বহন করে, দেশের সংবিধান, পতাকা, দেশের ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘু মানুষজনের অধিকার ইত্যাদিতে বিশ্বাস রাখে। অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত। অবশ্যই দু’দিকেই এমন ধান্দাবাজেরাও রয়েছে যারা যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও অছিলাতে শিবির পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু দুই জোটের বহু নেতা একথা জানার পরেও তাঁদের জোটের মধ্যেই রাখতে চান, কারণ তাঁরা জোট ছাড়লে, আখেরে তো অন্য জোটের লাভ। ইন্ডিয়া জোটের কেউই চন্দ্রবাবু নাইডু, জগন রেড্ডি, সি চন্দ্রশেখর রাও, নবীন পট্টনায়ক, দেবেগৌড়া, এমনকী মায়াবতীকে নিয়েও কটু কথা বলছেন না, কেন? কারণ হল, ইন্ডিয়া জোট জানে, এঁদের সমর্থন কাজে লাগতে পারে, কারণ বিভিন্ন কারণে এঁরা আপাতত নিউট্রাল আছেন বটে, কিন্তু নির্বাচনের পরে ফলফল হাতে নিয়ে এঁদের সমর্থন কাজে লাগতে পারে এবং এঁদের কেউই সেই অর্থে নরেন্দ্র মোদি বা আরএসএস–বিজেপির মত, পথ অনুসরণ করেন না। কারও বিরুদ্ধে ইডি আছে, কেউ নিজেদের রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান কিন্তু ওই ঘৃণা ছড়ানো সাম্প্রদায়িক কারখানার প্রডাক্ট এঁরা নন। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে, মানে ওই ইডি, সিবিআই উপেক্ষা করেও যাঁরা এই জোটে গিয়েছেন, আছেন, জোটের কথা বলছেন, বৈঠকে যাচ্ছেন, যাঁরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাঁদেরকে সরিয়ে দেওয়ার, বা বিরুদ্ধ শিবিরে ঠেলে দেওয়ার মতো বোকামি আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা ছাড়া আর কেউ করবে বলে তো মনে হয় না। স্তালিন জানতেন না আমেরিকা কী চায়? নাকি আমেরিকা জানত না স্তালিন কী চায়? জানত কিন্তু হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওই জোটকে তাঁরা অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইন্ডিয়া বৈঠক, নতুন কারা যোগ দিচ্ছেন? কোন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে?
সে কথা থাক, আরএসএস–বিজেপি বা মোদি-শাহের বিরোধিতায় গড়ে ওঠা ইন্ডিয়া জোটের বড় শরিকদের প্রাপ্তির ঝোলাতে কী আছে বা কী থাকতে পারে সেটা জানলে এই জোটে তাদের ভূমিকা, তাদের কমিটমেন্ট বুঝতে সুবিধে হবে। সবথেকে বড় স্টেক দেশের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের। কংগ্রেস তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন তলানিতে এসে ঠেকেছে, এরপরে আরও নামলে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, কাজেই তাদের স্টেক সবচেয়ে বড়। জোট হলে তাদের সবথেকে বেশি লাভ, মিলিজুলি সরকারে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পদ পেল কি না পেল, তা নিয়ে তাদের খুব মাথাব্যথা নেই, আপাতত লক্ষ্য দলকে টোটাল ডেস্ট্রাকশনের হাত থেকে বাঁচানো। দু’ নম্বর দল আপ, তাদের মূল ভিত্তিভূমি যদিও কংগ্রেস শাসিত রাজ্য কিন্তু তারা বুঝেছে যে বিজেপি থাকলে তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন, এবং তারা জানে দেশজুড়ে তাঁদের অস্তিত্ব এখনও তত বড় নয় যা দিয়ে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে। তাদের ন্যূনতম চাহিদা হল বিজেপিকে ২৪০-২৫০-এর নীচে রাখা এবং এই জোটে থেকেই তাঁদের ছড়িয়ে পড়ার হিসেব তারা করছে। তৃণমূলের আপাতত চাহিদা সংখ্যালঘু ভোটকে নিজেদের দিকে রাখা এবং বিভিন্ন এজেন্সির আক্রমণকে আটকানো, বিভিন্ন রাজ্যে বেড়ে ওঠার চিন্তা তাদের মাথাতে আছে, তবে সেটা প্রায়োরিটি তাদের নয়। আরজেডি বা নীতীশের সমস্যা টিকে থাকার, দলকে টিকিয়ে রাখার, বিহারের ক্ষমতায় থাকাটা জরুরি, বিজেপির কাছে দুই দলের অস্তিত্ব বিপন্ন সবদিক থেকেই। মহারাষ্ট্রের শরদ পাওয়ার বা উদ্ধব ঠাকরের দল বিজেপি ইতিমধ্যেই ভেঙেছে, জোটে না থাকলে দু’ নম্বর অপশন বিজেপির জোট এনডিএ-তে চলে যাওয়া, তাতে খুব সমস্যা আছে বলে মনে হয় না, কিন্তু এনডিএ-তে গেলে এই দুই দলের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকবে না, এটাই এদের জোটে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ। দক্ষিণের ডিএমকে কেন এই জোটে? মূল কারণ রাজ্যে তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এআইডিএমকে এনডিএ-তে আছে, তাই। কারণ এই ডিএমকে কিছুদিন আগেও বিজেপির সঙ্গে ঘর করেছে। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি লড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধেই, বিরোধী জোটে থাকা তাদের কাছে খানিকটা আনুষ্ঠানিক, তাদের পক্ষে অন্য জোটে যাওয়াটা অসম্ভব। রইল বাকি কমিউনিস্টরা, এই জোটের থেকে তাদের কোনও প্রাপ্তিই নেই কারণ তারা ওই এক ত্রিপুরা ছাড়া কোথাও বিজেপির সঙ্গে লড়ছে না। কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের লড়াই, বাকি কোথাও তারা নেই।
এবার প্রাপ্তির হিসেবে দলের অঙ্গীকারের দিকটা দেখুন, কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএম বা সিপিআই-এর এই জোট থেকে প্রাপ্তি শূন্য, কাজেই কমিটমেন্টও নিল, তারা জোটের মূল দুই শরিকদের বিরুদ্ধে লাগাতার কথাও বলে যাবে, আবার জোটেও থাকবে। সমাজবাদী দলের অন্য কোনও রাস্তা নেই, কিন্তু জোটে তাদের উপস্থিতি আনুষ্ঠানিক। ডিএমকে থাকবে এই জোটে, রাজ্য রাজনীতির বাধ্যবাধকতার জন্যেই, অন্য কোনও কারণে নয়। কমিটমেন্ট মাঝারি, কিন্তু মোদি সরকারের ভিজিলেন্স এজেন্সির আক্রমণ তাদেরও আক্রমণাত্মক করে তুলছে। আরজেডি, লালু, জেডিইউ, নীতীশের জন্য এই জোট টিকে থাকার রসদ, কাজেই মান অভিমান ছেড়ে তাঁরা জোটে থাকবেন। তৃণমূলের জন্য জোট জরুরি, এই জোট বিজেপির বিরুদ্ধে, সেই জোটের অন্যতম শরিক তৃণমূল দল এই তকমা রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষয় আটকাবে এবং মোদি সরকারের ক্রমাগত ইডি সিবিআই আক্রমণের মুখে তৃণমূলের এই জোট জরুরি, অতএব কমিটমেন্ট হাই, কিন্তু তা স্থির নয় গত্যন্তর না দেখলে আরেকটা নবীন পট্টনায়েক আমরা এ রাজ্যেই দেখতে পাব। আপ-এর চাহিদা দেশের ক্ষমতা, তা করতে গেলে দলকে বাঁচাতে গেলে আপাতত তাদের বিরোধী শিবিরে থাকতেই হবে, কিন্তু বিজেপির বিপদ কাটলেই তাদের অন্য রূপ দেখা যাবে, সেটাও স্বাভাবিক। কংগ্রেসের কমিটমেন্ট সবথেকে বেশি, তাই তারা আত্মত্যাগ করতেও রাজি, বিজেপি সরে গেলেই আবার তাদের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার হবে, এটাই তাদের আশা। এইসব বিষয়গুলোকে মাথায় রাখলে ইন্ডিয়া জোট আর তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ আরও ভালো বোঝা যাবে।