তিন নয়, আট কিংবা দশ নয়, আগামী পাঁচ মাসের মাথায় বাংলার সরকার, তৃণমূলের সরকার, মমতার সরকার, বাংলার গরিষ্ঠাংশ মানুষের রায়ে তৈরি এক সরকার পড়ে যাবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই খবর জানিয়েছেন বিজেপির দু’জন সাংসদ, শান্তনু ঠাকুর আর সুকান্ত মজুমদার। এখন, এটা তো আমরা জানি যে এনাদের একজনও রাস্তার ধারে টিয়া পাখি নিয়ে বসেন না, এই দুজন সেই অর্থে উন্মাদ নন। তাহলে এই কথা বলছেন কেন? বলছেন কীসের ভিত্তিতে? খেয়াল করে দেখুন শুভেন্দু অধিকারী বারকয়েক ৩৫৫ ধারার দাবি করেছেন, সরকার ভেঙে দেওয়ার দাবি করেছেন। বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা হওয়ার সুবাদে বারকয়েক এমন কথা হাওয়ায় ভাসিয়েছেন যে তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, সময় এলেই তাঁরা দল ভেঙে বিজেপির সঙ্গে যাবেন, সেটা নাকি কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু সেই সাত মন তেলও পোড়েনি, রাধাও নাচেনি। কিছুদিন পর থেকেই এসব বাজে বকা শুভেন্দুকে থামাতে হয়েছিল কারণ অপারেশন কমলের বদলে অপারেশন ঘাসফুল শুরু হয়ে গিয়েছিল, বিজেপির বিধায়কেরা তৃণমূলের দফতরে গিয়ে পতাকা ধরতে শুরু করলেন। আপাতত শুভেন্দু বিজেপির দিল্লির নেতৃত্বের মতলব নিয়েই খানিক সন্দিহান, ওনার সন্দেহ, তলায় তলায় কোনও বোঝাপড়া হচ্ছে নাকি? সেই জন্যই চরম হতাশ শুভেন্দু নিজের বিধানসভায় ১০ হাজারের বেশি ভোটে হারার পরে বলে ফেলেছিলেন, দলীয় পতাকা ছেড়েও তিনি বিরোধী ঐক্য গড়ে তুলতে রাজি। উনি বিলক্ষণ বুঝেছেন যে ওনাদের ভোট কমছে আর বাম কংগ্রেসের ভোট বাড়ছে, এমন এক পরিস্থিতিতে বিরোধী ঐক্য ছাড়া তৃণমূলকে হারানো অসম্ভব। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর বা সুকান্তর এত জটিল রাজনীতি মাথায় ঢোকে না, ঢুকবেও না, কাজেই সবথেকে সহজ ইচ্ছেপুরণের কথাটা বলে ফেলেছেন, সরকার পড়ে যাবে, পাঁচ মাসের মধ্যেই সরকার ভেঙে দেওয়া হবে। এটাই আমাদের বিষয় আজকে, পাঁচ মাসে এ বাংলার সরকার পড়ে যাবে?
আবাল শিশুদের মধ্যে এই তাড়াহুড়ো দেখেছি, অপরিণত কিশোরদের মধ্যেও দেখেছি তাড়াহুড়ো, কিন্তু শান্তনু ঠাকুর বা বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারদের মধ্যে সরকার ফেলে দেওয়ার এই তাড়াহুড়ো কেন? এক নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে বিজেপির সরকার তৈরি হবে? তৈরি হওয়া সম্ভব? আসলে এটা হল আগের বলা কথার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এক রাজনৈতিক দাবি তোলা। বেশ কিছুদিন হল বিজেপির দিল্লি নেতারা, মোদি-শাহ বেশ পরিষ্কার বুঝেছেন যে মহারাষ্ট্র, বিহার, বাংলা আর কর্নাটকে আগের রেজাল্টকে যে কোনও মূল্যে ধরে রাখতে হবে। মহারাষ্ট্রে ৪৮টা আসন, বাংলায় ৪২, বিহারে ৪০, আর কর্নাটকে ২৮টা আসন আছে। কর্নাটকে বিজেপি পেয়েছিল ২৬টা, বাংলায় ১৮টা, বিহারে বিজেপি এনডিএ পেয়েছিল ৩৯, মহারাষ্ট্রে ৪১টা এনডিএ পেয়েছিল। মানে ১৫৮টা আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছিল ১২৪টা আসন।
আরও পড়ুন: Aajke | নবজোয়ার আসুক পঞ্চায়েতে
এবারে এই আসন ধরে রাখার জন্য বিজেপি যা যা করার সেটা করছে। তারা শিবসেনা ভেঙেছে, দু’দিন আগে চোর বলা এনসিপিকে ভেঙেছে, নীতীশের দল জেডিইউ-কে ভাঙার চেষ্টা করছে, তেজস্বী যাদবের পিছনে ঘুরছে ইডি সিবিআই, বাংলাতেও ইডি আর সিবিআই হানা চলছে, কর্নাটকে এমনকী জেডিএস-এর সঙ্গেও জোট বাঁধার কথা চলছে। এ বাংলাতে, সেই কারণেই ক’দিন ধরে দিল্লির নেতাদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল, রাজ্য নেতাদের প্রচুর ভোকাল টনিক দেওয়া হয়েছে, নানান পদ্ধতি বাতলানো হয়েছে, কিন্তু এসব করার পরে ২০১৯-এর ৪০ শতাংশ ভোট থেকে ২০২১-এ ৩৮ শতাংশ ভোট থেকে এবারে পঞ্চায়েত বিজেপি ২৪ শতাংশ ভোটে এসে ঠেকেছে। কিন্তু তা লুকোতে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব কিছু হাস্যকর পরিসংখ্যান পাঠিয়েছেন দিল্লির নেতাদের কাছে। জানিয়েছেন ২০১৮তে তাঁদের ভোট ছিল ২০ শতাংশ এবার ৪ শতাংশ বেড়ে তা হয়েছে ২৪ শতাংশ। কিন্তু এর মধ্যে সেই ভোট ৪০ শতাংশে চলে গিয়েছিল বা এর আগের বিধানসভার ভোটে তা ৩৮ শতাংশ হয়েছিল, তা চেপে গিয়েছেন। সেই সত্যিটা ঢাকতেই ওনাদের এই ৩৫৫ ধারা সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি, তাই নিয়েই মাঠে নেমেছেন সুকান্ত শান্তনু ঠাকুরেরা। এক নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু করার মতো এক অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির কথা ক্রমাগত বলেই চলেছেন এক র ফলা রি ফলা বর্জিত অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি দিল্লির মধুভাণ্ডের ভাগ পেতেই আপাতত ঘোর বিজেপি, তো সেই তিনি চ্যানেলে, ইউটিউবে, সর্বত্র ওই ৩৫৫ ধারা লাগু করার সপক্ষে যুক্তি দিয়েই চলেছেন। আমরা মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর মানুষের সমর্থন নিয়ে এক নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে রাজ্য বিজেপি নেতারা, এই হুমকি দেওয়া কে কি সাধারণ মানুষের সমর্থন করবে? শুনুন মানুষ কী বলছেন।
তৃণমূল সরকার এক বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি জনসংখ্যার সমর্থন পাচ্ছে, তৃণমূলের বিভিন্ন প্রকল্পে বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছে, তৃণমূলের আমলে কিছুটা হলেও রাস্তা, হাসপাতাল, আলো ইত্যাদির হাল ফিরেছে। কিন্তু এর উল্টোদিকে তৃণমূলের কি দোষ একটা? তৃণমূল কি সর্বত্র দারুণ কাজ করছে? তৃণমূলের নেতাদের দুর্নীতির কথা কি আমরা জানি না, জানি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইটা সহজ নয়, র ফলা রি ফলা হীন অধ্যাপক বাবু কিংবা টেনশন অনীক দত্তদের মিথ্যাচার দিয়ে তার মোকাবিলা সম্ভব নয়, এর জন্য লাগাতার লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে হবে, সেই ধৈর্য নেই শান্তনু ঠাকুর বা সুকান্ত মজুমদারদের, কাজেই ৩৫৫ ছাড়া অন্য কিছুই তাঁদের মাথায় ঢুকছে না।