কলকাতা: দশ মাসের ব্যবধান৷ বাংলার রং ফের একবার সবুজ৷ ২ মে ফিরল ২ মার্চে৷
এক রাজ্যে ১০৮ পুরসভা৷ ঘাস ফুল ফুটল ১০২টিতে৷ বিধানসভা ভোটে কিছুটা ছবি দেখা গিয়েছিল পদ্মের৷ পুরসভায় ধুয়েমুছে সাফ৷ একটি পুরসভা পেয়ে কিছুটা সম্মান ফিরে পেল বামেরা৷ চারটি ত্রিশঙ্কু৷ ঝালদা, বেলডাঙা, এগরা, চাঁপদানি। দার্জিলিং হামরো পার্টির দখলে৷ কিন্তু, আসল কথা, বাংলার ফের সবুজ আবিরেই ভরসা রাখল৷ ভরসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর৷ ভরসা রাখল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর৷
দশ মাস আগেই ছবিটা বোঝা গিয়েছিল৷ বাংলার মানুষ কতটা প্রত্যাখ্যান করেছে বিজেপিকে৷ দু’হাত মমতার দিকেই বাড়িয়ে দিয়েছে৷ বিধানসভায় যে আস্থা তাঁরা রেখেছিল, তার ছবি দেখা গিয়েছিল কলকাতা, শিলিগুড়ি, বিধাননগর, চন্দননগর পুরভোটে৷ আর রাজ্য জুড়ে ১০৮ পুরসভায় ফের একবার তৃণমূলের জয়জয়কার৷
ভোটের দিন বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছিল৷ সংবাদ মাধ্যমের একাংশ তৃণমূলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছিল৷ কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি ভোট লুট, ছাপ্পা ইত্যাদির অভিযোগ করছিল৷ যেমনটা প্রতিবার পরাজয়ের আভাস পেয়ে করে থাকে৷ অন্তত শেষ দশ বছর বাংলা এমনটাই দেখেছে৷
ফল ঘোষণা হতেই উচ্ছসিত জয়ী তৃণমূল প্রার্খী৷
২০১১ বিধানসভা ভোট৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বামেদের অহংকার চূর্ণ করে মহাকরণে পা রেখেছিলেন মমতা৷ সেই শুরু বামেদের পতন আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট লুটের অভিযোগ করা৷ পরবর্তী দুই বিধানসভা নির্বাচনে যত মানুষ তৃণমূল সমর্থন করেছে ততই বাম-কংগ্রেস-বিজেপি ভোট লুটের অভিযোগ করেছে৷ আশ্চর্য, কোনও অভিযোগই ধোপে ডেকেনি৷ প্রমাণ মেলেনি৷ নির্বাচন কমিশন নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে বলে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলি হেলনে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েও ভোট হয়েছিল গত বিধানসভায়৷ সেখানেও তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছে৷ বিজেপি-সহ বিরোধীরা ভোট লুটের হাস্যকর অভিযোগ করেও কিছু করতে পারেনি৷
তাই, বলাই যায়, অভিযোগ, অভিযোগের জায়গাতে রয়েছে৷ লুট-ছাপ্পা-হিংসার কথা বিধানসভা ভোটেও শোনা গিয়েছিল, সেখানে তো কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল৷ তাহলে কি কেন্দ্রীয় বাহিনীও ব্যর্থ? সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বিজেপি-সহ বিরোধীরা দিতে পারেনি৷ স্বাভাবিক ভাবেই এবারও পুরসভা ভোটের দিন থেকেই হিংসার অভিযোগ তুলেছিল বাম-বিজেপিরা৷ কারণ, বাংলায় তারা আগেই প্রত্যাখ্যাত৷ এবারের পুরভোটে ফল যে তাদের অনুকূলে যাবে না, আগেই বুজে গিয়েছিল আলিমুদ্দিন-মুরলিধর সেন লেন৷
তৃণমূলের এই সাফল্য একদিনে আসেনি৷ রাজ্য জুড়ে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে যে উন্নয়নের কর্মসূচি চলছে নিঃসন্দেহে এটা তারই ফল৷ যারা ভোটের ফল নিয়ে বিশ্লেষম করেন, তাঁদের মত, ছাপ্পা,রিগিং, বুথ জ্যাম করে অল্প কিছু সাফল্য আসে৷ এ ভাবে সর্বত্র জয়জয়কার হতে পারে না৷ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশ গ্রহণ ছাড়া এত বিপুল সাফল্য আসতে পারে না৷
এবারের পুরভোট বেশ কয়েকটা দিক স্পষ্ট করল৷
প্রথমত, বাংলার মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই৷ তৃণমূল নেত্রীকে সামনে রেখেই বহরমপুরের মত জায়গা আজ হাত মুক্ত৷ এতদিন শোনা যেত, অধীররঞ্জন চৌধুরী আর বহরমপুর নাকি অভিন্ন হৃদয়ের৷ না৷ বাংলার মানুষ ভুল প্রমাণ করলেন৷ অধীর নয়৷ বাংলা চাই মমতাকে৷ তাই, পুরভোটে অধীরকেই প্রত্যাখান করতে দু’বার ভাবল না বহরমপুর৷
দ্বিতীয়ত, পঞ্চাশ বছরের বেশি৷ কাঁথি পুরসভা ছিল অধিকারী পরিবারের অধিকারে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকারীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-তৃণমূল কংগ্রেসের সহায়তায় সেই অধিকারকে আরও দৃঢ় করেছে৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করার ফল আজ ভালভাবে বুঝতে পারল শান্তিকুঞ্জ৷ মমতার মমতা সরে যাওয়ার ফল পেলেন শিশির অধিকারীরা৷ কাঁথি পুরসভা তৃণমূলের৷ যেখানে শিশির-শুভেন্দু-দিব্যেন্দুদের কোনও ভূমিকা নেই৷ আরও স্পষ্ট করে বললে, বিরোধী দলনেতা নিজের পাড়াতেই আজ ব্রাত্য৷
আরও পড়ুন-এসএলএসটি নিয়োগে দুর্নীতি মামলায় সিবিআই অনুসন্ধানের নির্দেশে স্থগিতাদেশ হাইকোর্টের
তৃতীয়ত, বালুরঘাট এবং খড়গপুর৷ সুকান্ত মজুমদার এবং দিলীপ ঘোষ৷ নিঃসন্দেহে বঙ্গবিজেপির দুই মুখ৷ নিজেদের এলাকাতেও পদ্মফুল ফোটাতে পারলেন না৷ যে হিরণ্ময়কে একাধিকবার কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল, সেই অভিনেতার হাত ধরেই কিছুটা মুখরক্ষা হল দিলীপের৷ বাকি সবই মমতাময়৷
চতুর্থত, এবারের পুরভোটে দ্বিতীয়স্থানে নির্দল প্রার্থীরা৷ তাৎপর্যপূর্ণ এখানে৷ ভোটাররা বাম-বিজেপি-কংগ্রেস কোনও দলকে তৃণমূলের বিরোধী হিসাবে দেখতে চাইলেন না৷ যেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বাম-রাম-কংগ্রেস সমঝোতাকেই প্রমাণ করল৷ তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, বিরোধিতা নয়, এই তিনটি রাজনৈতিক দল সমঝোতা করে চলে৷ দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা নির্দল যেন সেটাই বোঝাচ্ছে৷
পঞ্চমত, পুরভোট নিঃসন্দেহে অক্সিজেন দিল বামেদের৷ দশ মাস আগে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বাংলা৷ বাম নেতারা কংগ্রেস-আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে মুখ খুলেছিলেন৷ ভুল স্বীকার করেছিলেন৷ তার ফল মিলল৷ ২২৭৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬৫ ওয়ার্ডে জয় পেলেন বাম প্রার্থী৷ কিছুটা অক্সিজেন অবশ্যই ফিরলল৷ তাও ফিরল তরুণ নেতাদের হাত ধরে৷ যারা দিনরাত এককরে অক্সিজেন পৌঁছে ছিলেন করোনা আক্রান্তের ঘরে৷
আরও পড়ুন-Russia-Ukraine War: রুশ সেনার ঘেরাটোপে জনবহুল খারকিভ, রকেট হামলায় নিহত ২১
ষষ্ঠত, সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আগেই তৃণমূল সরব ছিল৷ এ দিন ভোটের ফল প্রকাশের পর মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, কয়েক হাজার বুথের মধ্যে ৭-৮টি বুথের ছবি বারবার দেখানো হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনও সে কথায় বলেছে৷ দু’টি বুথে কমিশন পুনর্নির্বাচনও করেছে৷ মমতা-নির্বাচন কমিশন দু’য়ের মন্তব্যই প্রমাণ করছে, হামলার যে দাবি উঠেছিল, তা বিক্ষিপ্ত৷
তৃণমূলের এই জয়ের পর মমতা মন্তব্য, দায়িত্ব বাড়ল৷ নম্র হতে হবে৷
কর্মীদের চাঙ্গা করলেন৷ অক্সিজেন যোগালেন৷ বুঝিয়ে দিলেন, হিংসা নয়, নম্রতাই বাংলার উন্নয়নের চাবি কাঠি৷