এক্কেবারে স্বাভাবিক মানুষ পাওয়া ভারী কঠিন। রাগ নেই, দ্বেষ নেই, হিংসা নেই, অভিমান নেই, লোভও নেই এমন মানুষ বা বলা ভালো এরকম মহাত্মা খুবই কম, নেই বললেই চলে। এবং এই সবের মূলে হল দুটো ঝোঁক, এক নিজেকে ছোট ভাবতে থাকা, আমার তো কিছুই নেই, আমি তো কিছুই পারি না, আমার দ্বারা কিছুই হবে না, এই একটা ঝোঁক, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স, অন্যটা ঠিক এর বিপরীত। আমি সব জানি, আমি সব পারি, আমি সবার থেকে ভালো, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। কম বেশি প্রত্যেক মানুষের এই ঝোঁকের কোনও একটা থাকে, কিন্তু কম থাকলে সমস্যাটা বাইরে থেকে দেখা যায় না, বেশি থাকলেই তা সবার চোখে পড়ে। এবং দুই ক্ষেত্রেই এই দুই ঝোঁক, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু একই ধাঁচের, মনে মনে গজরাতে থাকা, তারপর রেগে গিয়ে আলফাল বকা। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এমন কিছু বলা যা নিয়ে হই চই হবে, এই ঝোঁক সাধারণ মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, তার জন্য ধারাবাহিক চিকিৎসা দরকার। এই ইনফিরিয়রিটি বা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া মানুষজন সর্বগ্রাহ্য সামাজিক নিয়ম কানুন, সর্বগ্রাহ্য মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বা সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষজনদের অপমানসূচক কথা বলে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন। এর ভূরি ভূরি নিদর্শন আমরা দেখেছি, সেই তালিকায় নতুন সংযোজন বিশ্ব ভারতীর ভাইস চ্যান্সেলর বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
সারা পৃথিবী জানে অমর্ত্য সেনের কথা, সারা পৃথিবীতে তিনি পরিচিত এক অর্থনীতিবিদ হিসেবে, একজন নোবেল লরিয়েট হিসেবে, একজন দার্শনিক চিন্তাবিদ হিসেবে। তাঁকে বিদ্যুৎবাবু মিথ্যেবাদী বললেন, প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমে। বললেন উনি দাবি করেন বটে উনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, কিন্তু আসলে ওটা নোবেল নয়, তারপর যুক্তি হিসেবে যা বললেন তা এক অর্ধসত্য তথ্যের সমাহার। কেন বললেন? বললেন কারণ তিনি অসুস্থ, মানসিকভাবে অসুস্থ। অন্তত সেই অসুখের বহিঃপ্রকাশেই এমন আচরণ দেখা যায়। তারপর পড়লেন অমর্ত্য সেনের বাড়ি প্রতীচীর জমি নিয়ে, দেশে জমি সংক্রান্ত ডিসপিউট, যে কোনও জটিলতা দেখার জন্য ল্যান্ড অ্যান্ড ল্যান্ড রেভিনিউ দফতর আছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই দফতরের কাগজ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনেই অমর্ত্য সেনের হাতে তুলে দিলেন। মূলত দেখার কথা বিশ্বভারতীর পড়াশুনো, নতুন ফ্যাকাল্টি, নতুন শিক্ষা সম্বন্ধীয় সুযোগ সুবিধার বিষয়, কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ব্যস্ত অমর্ত্য সেনের জমিজিরেত নিয়ে, সেও সেই জমিজিরেত যা এখন এক ট্রাস্ট দেখাশোনা করছে, যে ট্রাস্টের কাজ হল প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার।
কেন বিদ্যুৎবাবু এটা করছেন? কারণ আবার সেই দৃষ্টি আকর্ষণ, নিজেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, জগৎবরেণ্য নোবেল লরিয়েটের পাশে দেখতে চাওয়া। এবং সে কাজে তিনি খানিক সফলও, কাগজে কাগজে ওনার ছবিও ছাপা হয়েছে, টিভিতে সাক্ষাৎকারও দেখানো হয়েছে, এই তো আমরা চতুর্থ স্তম্ভে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছি, উনি খানিকটা তো সফল। ওনার রোগ নির্ণয় হোক, সেই অনুযায়ী ওনার চিকিৎসা হোক, উনি সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু আজ তা নিয়ে আলোচনা নয়। উনি অসুস্থ বা অসুস্থ নন, সে বিচার তো ডাক্তারবাবুরা করবেন, যদি উনি অসুস্থ হন তাহলে উনি কী ভাট বকলেন তা নিয়ে আলোচনার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু উনি অসুস্থ বা সুস্থ যাই হোন না কেন, বিশ্বভারতীর ভাইস চ্যান্সেলরের কাছ থেকে আমরা শুদ্ধ বাংলা তো আশা করতেই পারি, তাই না? মানে রবি ঠাকুরের প্রাঙ্গণে এক উপাচার্য অন্তত শুদ্ধ বাংলা জানবেন, এটা আশা করাটাই তো স্বাভাবিক। আজ সেটা নিয়ে আলোচনা, ওনার ভাট বকাকে পাশে সরিয়ে রেখে আজ আমরা ওনার বাংলা, বিদ্যুৎ-বাংলা নিয়ে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: আদানি কা চৌকিদার কোন হ্যায়?
অমর্ত্য সেন আসলে বেআইনিভাবে জমি দখল করে রেখেছেন, ইত্যাদি বলার পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অমর্ত্য সেনের বাড়ি গিয়ে নিজেই ওই জমির কাগজপত্র তাঁর হাতে তুলে দেন, সাংবাদিকদের জানান ল্যান্ড অ্যান্ড ল্যান্ড রেভিনিউ দফতরের এই কাগজই জানাচ্ছে অমর্ত্য সেন দখলদার নন। কাজেই বিদ্যুৎবাবুর কাছে এক সহজ সুযোগ এসে গেল, অমর্ত্য সেনকে মিথ্যেবাদী, জমি দখলদার বলে খবর হচ্ছিল কিন্তু ওনার ফার্স্ট পেজ হেডলাইন চাই, তাহলে? তাহলে উপায় হল নজিরবিহীনভাবে মুখ্যমন্ত্রীকেই আক্রমণ করা। তিনি তাই করলেন, বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিককে দিয়ে এক বিবৃতি জারি করালেন, সই করেছেন সেই আধিকারিক কিন্তু অবশ্যই এই বিবৃতি মহামান্য ভাইস চ্যান্সেলর বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর, এর প্রতিটা শব্দের দায় ওনার। তো আবার বলছি ওনার ভাট বকাতে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, কিন্তু উনি বিশ্বভারতীর উপাচার্য, রবি ঠাকুরের প্রাঙ্গণের এক শিক্ষক, আমরা ওনার বাংলা নিয়ে, হ্যাঁ বাংলা ব্যাকরণ আর বানান নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। প্রথমেই বলে রাখি, এই দলিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল, বিশ্বভারতীর উপাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বেনজির আক্রমণ করছেন এই বিবৃতিতে, অতএব তা বহুবার দেখার পর, সংশোধন আর পরিমার্জনের পরেই জারি করা হয়েছে বলে আশা করাই যায়। তো আসুন সেই বিবৃতির দিকে একটু নজর দিই। তিনি কী বলছেন তা নিয়ে নয়, তিনি কোন ভাষায় বলছেন, তা নিয়ে।
প্রথম স্তবকেই তিনি বলছেন, ‘তার মধ্যে একজন শিক্ষকের বক্তব্য শুনে এবং ছয়জন ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্য শুনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমন করলেন।’ আক্রমণ-এ দন্ত্য ন! মাননীয় উপাচার্য, আক্রমণে মূর্ধণ্য ণ হয়, দন্ত্য ন নয়। আপনি বরং রবি ঠাকুরের চিত্রা কাব্যগ্রন্থের নববর্ষে কবিতাটা পড়ে ফেলুন, যতক্ষণ আছ হেথা স্থিরদীপ্তি থাকো, তারার মতন।
সুখ যদি নাহি পাও, শান্তি মনে রাখো করিয়া যতন।
যুদ্ধ করি নিরবধি, বাঁচিতে না পার যদি,
পরাভব করে আক্রমণ,
কেমনে মরিতে হয় তবে শেখো তাই করি প্রাণপণ।
আপনি অন্তত আক্রমণ বানানটা শিখে নিন। এরপর আপনি অনেক জায়গায় তাকে, তাদের লিখেছেন, সেগুলোতে চন্দ্রবিন্দু দিতে হয়, মানুষকে সম্মান দিতে শিখুন। এরপর লিখেছেন শাস্তি বিধান তৎক্ষনাৎ, আবার দন্ত্য ন, ক্ষণ শব্দে মূর্ধণ্য ণ হয়, এবার থেকে মনে রাখবেন। এবং তারপর কেলেঙ্কারি, শব্দের মানেই জানেন না বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। যিনি নাকি উপাচার্য, বিশ্বভারতীর, লিখেছেন, তাদের পরীক্ষা দেওয়া থেকে নিরত করা হয়েছে, স্যর, নিরত শব্দের মানে নিযুক্ত করা, আপনি সম্ভবত বিরত লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলা শব্দভাণ্ডার কম থাকার ফলে বিরতকে নিরত লিখেছেন। এরপরে বিদ্যুৎবাবুর বিবৃতিতে আছে শাস্তি মুকুব হয়ে যেত, শব্দটা মকুব, মুকুব নয়, আরবি মরকুফ থেকে মকুব শব্দ এসেছে। এরপরে বিদ্যুৎবাবুর বিবৃতিতে ছাত্রগুলো শব্দটা ব্যবহার হয়েছে। এখন বিদ্যুৎবাবু ছাত্রদের উচ্ছে, বেগুন, পটল, মুলো ভাবতেই পারেন কিন্তু সভ্য সমাজে ছাত্র বহুবচনে ছাত্ররা, ছাত্রগণ হয়, ছাত্রগুলো নয়, ওটা আমরা মনুষ্যেতর জন্তু জানোয়ারের বিষয়ে ব্যবহার করি, বাঁদরগুলো, হনুমানগুলো, কিন্তু ছাত্ররা, ছাত্রগণ। এরপর প্রমাণ শব্দে বিদ্যুৎবাবু মূর্ধণ্য ণ ব্যবহার না করে দন্ত্য ন ব্যবহার করেছেন, ওনার ণত্ব বিধান ষত্ব বিধানের ক্লাস করা উচিত, ওই বিশ্বভারতীতেই খোলা মাঠে বসে ছাত্রগুলোর নয়, ছাত্রদের সঙ্গে বসেই শেখা উচিত। এরপর আবার ছাত্রীটি- টি, টা, খানা, খানি কোথায় ব্যবহার হয়, বিশ্বভারতীর উপাচার্য তা জানেন না। এরপর নির্দিষ্ট শব্দে দু’ বার দ, তাতে করে উনি হয়তো ভেবেছেন শব্দটা পাকাপোক্ত হবে, কিন্তু আসলে তো তা নয়, একটা দ থাকলেই যথেষ্ট হবে বিদ্যুৎবাবু, বানানটা হল ন-এ হ্রস্ব ই দ-এ র ফলা হ্রস ই, কাটা মূর্ধণ্য ষ-এ টয়, নির্দিষ্ট।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar: আয়ের কড়ি, পারের কড়ি
চলুন এগোই, উনি লিখছেন, মাস্টারমশাই চাকরীর শর্ত লঙ্ঘন করে, এখানে চাকরিতে উনি র-এ দীর্ঘ ঈ বসিয়েছেন, তাতে কি চাকরির মাইনে বাড়বে বিদ্যুৎবাবু? এরপর তোরণ, মৌরসিপাট্টা আর গাত্রদাহ। তোরণ-এ ড এ শূন্য ড় দিয়েছেন, সম্ভবত তাড়াতাড়িতে ব-এ শূন্য র দেবেন, মৌরসিপাট্টায় দীর্ঘ ঈ দিয়েছেন, গাত্রদাহ বানানটা দেখলে গা ব্যথা করবে, ত-এ র ফলাতে ও কার জুড়েছেন। ও বিদ্যুৎবাবু, কথাটা গাত্রদাহ, গাত্রোদাহ নয়, মাথায় রাখুন। বিবৃতি পড়লে বোঝা যাবে, উনি কি আর কী-এর তফাত জানেন না, জানেন না কথাটা স্তাবক পরিবৃত্ত নয় স্তাবক পরিবৃত, জানেন না শিক্ষয়িত্রী বানান, লিখেছেন শিক্ষয়ত্রী, জানেন না প্ররোচনা, তৈরি বা করুন শব্দের বানান, করুন এ মূর্ধণ্য ণ্য দিয়েছেন, তৈরিতে র-এ দীর্ঘ ঈ আর প্ররোচনাতে মূর্ধণ্য ণ্য। বানানের বাপ মা করে ছাড়া এমন উপাচার্য সত্যিই আগে দেখা যায়নি। আসলে কি জানেন বিদ্যুৎবাবু, এসব যে আপনার অশিক্ষার পরিচয় তা আমরা মনে করি না, আর যাই হোক আপনাকে অশিক্ষিত বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, সমস্যাটা আরও গভীরে। আপনার মানসিক সন্তুলন নিয়েই আমাদের প্রশ্ন, আপনি কী লিখলেন তা নিয়ে আলোচনা তো বহু পরে হবে, রবি ঠাকুরের প্রাঙ্গণে বসে এমন অশুদ্ধ বাংলা লেখার দায়ে আপনাকে বাংলা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়াই যায়। আমরা তা দিচ্ছি না, আমরা বুঝতে পারছি স্পষ্ট যে আপনি অসুস্থ, এখন আমরা তো ডাক্তার নই, তাই আমাদের সন্দেহটা জানালাম, এবার আপনি ডাক্তার দেখাবেন কি না, ওষুধ খাবেন কি না, সে তো আপনার ব্যাপার। ততদিন ওই বিবৃতি দেওয়া বন্ধ রাখুন, আপাতত এটি আমাদের অনুরোধ, হাগুন্তির তো লাজ থাকে না, দেখুন্তির থাকে, আমাদের বাংলায় বিশ্বভারতীর উপাচার্যের এই বাংলা সত্যিই আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।