কলকাতা: হিংসার আবহেই আগামিকাল শনিবার রাজ্যে হতে চলেছে দশম পঞ্চায়েত ভোট (Panchayat Vote )। মনোনয়ন পর্বের শুরু থেকে ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানিতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই প্রাক পঞ্চায়েত হিংসার বলি হন পাঁচজন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা (Rajiva Sinha) এই হিংসা বন্ধ করার জন্য কোনও উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ করেন খোদ রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস (C. V. Ananda Bose)। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার রাজধর্ম পালন করেননি। তাঁর হাতে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। শত ধুলেও সেই দাগ মুছবে না। কমিশনারকে তাঁর পরামর্শ, এখনও সময় আছে। অ্যাকশন নিন।
ভোটের আগের দিন শুক্রবারও হিংসার বিরাম ছিল না। এদিন সকালে মুর্শিদাবাদের রানিনগরে এক কংগ্রেস কর্মী খুন হন। বেলায় বনগাঁয় এক ব্যক্তির রক্তাক্ত দেহ ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে বিক্ষিপ্ত বহু গোলমালের খবর এসেছে। কোথাও বিরোধী প্রার্থীকে হুমকি, মারধর, কোথাও বিরোধী সমর্থকদের শনিবার বুথের ধারেপাশে না যাওয়ার হুঁশিয়ারি, কোথাও ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো বিস্তর অভিযোগ উঠেছে দিনভর। আবার শাসকদলের উপর বিরোধীদের চড়াও হওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
এই অবস্থায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, শনিবার পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার ব্যাপারে তারা বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং সাধারণ মানুষ কমিশনের এই দাবিকে মান্যতা দিতে রাজি নয়। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু রাজ্যবাসীর মনে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে বছর পঞ্চায়েত ভোটের আগে পরে বহু মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমবাঙালিকে।
সেই কথা মাথায় রেখেই এবার প্রথম থেকে বিরোধী দলগুলি পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি করে আসছিল। সে ব্যাপারে রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত অনীহা ছিল। শেষে আদালতের চাপে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে রাজি হয় কমিশন। যদিও শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত পর্যাপ্ত বাহিনী পাওয়া নিয়ে একটা টানাপড়েন চলে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মহারাষ্ট্রে যে খেলা চলছে, তার পিছনের রাজনীতির ছকটা কেমন?
এবার পঞ্চায়েত ভোট হবে ৬০ হাজার ৫৯৩টি বুথে। মোট ভোটার ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ২১ হাজার ২৩৪। সব চেয়ে বেশি ভোটার রয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। ওই জেলার মোট ভোটার ৫৭ লক্ষ ৭৪ হাজার ৪৮২। চাহিদামতো কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়া গেলেও প্রতি বুথে সেই জওয়ানদের রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনও।
কমিশন জানিয়েছে, ২২ জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েতে ৬৩ হাজার ২২৯ আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৭০ হাজার ৮১২। পঞ্চায়েত সমিতির ৯ হাজার ৭৩০ আসনে প্রার্থী ৩১ হাজার ১৬ জন। আর জেলা পরিষদের ৯২৮ আসনে প্রার্থী আছেন ৪ হাজার ৪৬৭ জন।
২০১৮ সালে পঞ্চায়েতের তিন স্তরে প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। সেবার শাসকদল বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার ডাক দিয়েছিল। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ২০১৮ সালে সেই বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার মূল কারিগর ছিলেন। তখনকার দাপুটে তৃণমূল নেতা অধুনা বিজেপি নেতা ঘোষণা করেছিলেন, বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত দিতে পারলে ৫ কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। গত পঞ্চায়েত ভোটে হাজার হাজার আসনে বিরোধীরা প্রার্থীই দিতে পারেনি। এবার অবশ্য চিত্রটা কিছুটা হলেও বদলেছে। শাসকদলের হুমকি অগ্রাহ্য করে, মারধর খেয়েও বহু আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পেরেছে। শাসকদলের নেতারা বুক বাজিয়ে বলছেন, আমরা চাইলে আরও বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতাম। তাঁদের দাবি, গোলমাল হলে বিরোধীরা এত বেশি মনোনয়ন জমাই দিতে পারত না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দুতিনটি বুথে বিরোধীরা গোলমাল করেছে। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী দিতে হবে বলে লাফাচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী আমাদের কাঁচকলা করবে। এবার শাসকদল ১২ শতাংশের কিছু বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তিন স্তরের বহ আসনে।
এবারের পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদলের বড় হাতিয়ার রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা, একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্য, বিজেপি-বাম-কংগ্রেসের আঁতাঁত প্রভৃতি। এছাড়াও প্রচারের ইস্যু ছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতিসক্রিয়তা। বিরোধীদের মূল হাতিয়ার শাসকদলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং চুরি। বাম-কংগ্রেস তো স্লোগানই তুলেছে, চোর ধরো, জেল ভরো। বিজেপিও চুরি এবং দুর্নীতিকেই প্রচারে তুলে ধরেছে।
আরও পড়ুন: Panchayat Election 2023 | Central Force | শেষ লগ্নে পানাগড়ে পৌঁছল ৪৮৫ কোম্পানি
শাসকদলের গলার কাঁটা এবার বিক্ষুব্ধ নির্দল। বহু জায়গায় নেতৃত্বের হুমকি উপেক্ষা করে দলের লোকজন নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। অনেক জায়গায় বেশ কয়েকজন বিধায়ক এবং স্থানীয় নেতা বিক্ষুব্ধ নির্দলদের মদত করছেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে জেলাগুলিতে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবু বিদ্রোহ সামাল দিতে পারেনি শাসকদল।
আগামী বছর লোকসভা ভোটের আগে বাংলার এই পঞ্চায়েত ভোট শাসকদল, বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস সকলের কাছেই বড় পরীক্ষা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৯টি আসন দখল করে ধরাকে সরা ভাবতে শুরু করেছিল। ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে অমিক শাহরা দুশো আসনে জেতার কথা বললেও বিজেপির আসন দুই সংখ্যাও ছুঁতে পারেনি। গত দুই বছরে বাম-কংগ্রেস সামান্য হলেও পায়ের তলায় জমি ফিরে পেয়েছে। সাগরদিঘি বিধানসবা কেন্দ্রের উপ নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী জেতার পর দুই পক্ষই বলতে শুরু করে, সাগরদিঘি মডেলেই আগামিদিনে পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোট হবে। যদিও সেই কংগ্রেস প্রার্থী জেতার তিন মাসের মধ্যে তৃণমূলে ভিড়ে গিয়েছেন। এই মুহূর্তে বিরোধীদের হাতে একটিও জেলা পরিষদ নেই, সেটা মাথায় রাখতে হবে। পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল যদি প্রথম স্থানে থাকে, তবে দ্বিতীয় স্থানে কে থাকবে, তা নিয়ে অবশ্যই রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল থাকবে। বিরোধীরা দাবি করছে, মানুষ যদি নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে, তাহলে এই ভোটেই পাশার দান উল্টে যাবে। এখন প্রশ্ন হল, আগামিকাল মানুষ নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারবে তো?