কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: সংবাদ মাধ্যমের তিনটে দিক আছে, প্রথমটা হল খবর, নিউজ, দাদাঠাকুর মজা করে বলেছিলেন নর্থ, ইস্ট, ওয়েস্ট, সাউথ, এন ই ডাবলিউ এস, নিউজ। খবর যা ঘটেছে, ঘটছে, ঘটবে তাকে এক জায়গায় এনে রাখাটা সংবাদ মাধ্যমের প্রথম কাজ। এক্ষেত্রে বাছাবাছি তো হবেই, কিন্তু সেই বাছ বিচার হবে খবরের গুরুত্ব বিচার করে। বড় ঘটনা বলে কিছুই হয় না, সবটাই আপেক্ষিক, এখনই খবর এল এক বাস দুর্ঘটনার, মারা গেছেন ২৪ জন, বিরাট বড় ঘটনা। কিন্তু পরমূহুর্তেই যদি প্রধানমন্ত্রীর গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনা ঘটে? যেমনটা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর? তাহলে সেটা আগের খবর কে ছাপিয়ে বড় খবর। তো এই হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোকে এক জায়গায় এনে হাজির করা পাঠকদের কাছে বা দর্শকদের কাছে, সেটাই সংবাদমাধ্যমের প্রথম কাজ। এরপর হল খবরের গতিমুখ মানুষের কাছে তুলে ধরা। ধরুন একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন, এটা খবর, ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, কিন্তু তার সমর্থনে কতজন বিধায়ক বা সাংসদ আছেন, তারা সঙ্গে এলে সরকার পড়ে যেতে পারে নাকি পারে না, সেই তথ্য দিয়ে এই খবরের দিশামুখ এর হদিশ দেওয়াটাও সংবাদ মাধ্যমের কাজ। এবং শেষ বিষয়টা হল সম্পাদকীয় বা উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ইত্যাদি, যেখানে দেশ, সমাজ, রাজনীতি, খেলা, সিনেমা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে হয় সম্পাদক, নাহলে অন্য কারোর সুচিন্তিত মতামত। খবরের বাছবিচারের সময় কংগ্রেসের খবর দেবো, বিজেপির দেবো না, তৃণমূলের দেবো, সিপিএম এর দেবো না, এটা সংবাদ মাধ্যমের কাজের পরিপন্থী। কিন্তু সম্পাদকীয়? উত্তর সম্পাদকীয় লেখাইয়, অনুষ্ঠানে কাগজ যা মনে করে, সেই সংবাদ মাধ্যমের চিন্তা বা ধারণা যেমনটা, তার প্রতিফলন থাকে, থাকাটা অন্যায় নয়। আরেকটু সোজা করে বলি, আমাদের চ্যানেল সকাল থেকে সন্ধ্যে তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি ইত্যাদি দলের, বিভিন্ন মতের মানুষের, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের খবর দেয়, গুরুত্ব অনুযায়ী সেই খবর পরিবেশন করা হয়। কিন্তু চতুর্থ স্তম্ভ আমাদের সম্পাদকীয় অনুষ্ঠান, এখানে আমরা এক ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত, এক উদার গণতান্ত্রিক ভারত, আমাদের দেশের সংবিধান কে সামনে রেখে চলা ভারতবর্ষ এবং ভারতবাসীর কথা বলে। মানে এখানে আমাদের নীতি আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা আছে, আমরা হিন্দুত্ববাদী বা মুসলমান মৌলবাদের বিরোধী, আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধী, আমরা হিংসার বিরোধী, এগুলো আমাদের পলিসি, তার ছাপ থাকে এই চতুর্থ স্তম্ভে, এটা স্বীকার করতেও আমাদের দ্বিধা নেই। এবং এটা ভাবলে চলবে না যে এরকমটা কেবল আমাদেরই আছে, অন্য সংবাদ মাধ্যমের নেই, প্রত্যেকের আছে, এটা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে। এতদুর পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরেই গন্ডোগোলটা লেগেছে। এমন নয় যে সংবাদপত্র চিরটাকালই খুব ধোয়া তুলসিপাতা ছিল, বহু সময়েই তারা খবরের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করেছে, ভুল খবর দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, এসব ছিল। কিন্তু সেগুলো ছিল ব্যতিক্রম। ২০১৪ এবং তার পর থেকে সেই ব্যতিক্রমটাই হয়ে দাঁড়ালো নিয়ম। প্রচারের ধরনটা দেখুন, স্বাধীনতার পর থেকে এমনটা হয় নি, ২০১৪ পর্যন্ত দেশ পাকিস্থানের কাছে মাথা নত করেই থাকতো, এখন মুহতোড় জবাব দিচ্ছে, এই প্রথম। সীমান্ত এই প্রথম বারের জন্য সুরক্ষিত। আচ্ছা এই সংবাদমাধ্যমের মালিক সাংবাদিকরা কি ভুলেই গেছে আমাদের দেশ তিন তিন বার পাকিস্থানের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করেছে, তাকে হারিয়েছে, আমাদের কূটনীতির ফলে জন্ম নিয়েছে পাকিস্থান ভেঙে এক নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। হঠাৎ শোনা গ্যালো সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছে, এর আগে নাকি কখনও হয় নি। পৃথিবীর সমস্ত বিবাদমান সীমান্তের দেশ অঘোষিত যুদ্ধ চালায়, তার বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে একটা হল সার্জিকাল স্ট্রাইক। অন্যপক্ষ কে জানতে না দিয়ে হঠাৎ সীমান্ত পার করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ। নতুন কিছুই নয়, ভারতবর্ষ বহুবার করেছে, পাকিস্থানও করেছে। কিন্তু বিজেপি নয়, তাদের ভক্তরা নয়, দেশের সংবাদ মাধ্যম মানুষকে বোঝাচ্ছে, এমনটি নাকি এর আগে আর কখনো হয় নি। এরকম এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদ কে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে দেশের সরকার নিয়ে, দেশের সরকার কে, দেশের প্রধানমন্ত্রী কে যারাই প্রশ্ন করবে তারাই দেশদ্রোহী, তারা টুকরে টুকরে গ্যাং, তারা গদ্দার, তাদের জেলে পোরা হোক। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে তারা আসলে মুসলমান তোষণ করছে, তারা হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে, যারা গরু খায় তাদের বয়কট করো, তাদের সিনেমাও বয়কট করো। এসব বিজেপিই শুধু বলছে না, ভক্তরাই শুধু বলছে না, বলছে সংবাদ মাধ্যম। আরেক প্রচার শুরু হয়েছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল দালালির, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য লড়ে নি, তাদের জন্য দেশভাগ হয়েছে, গান্ধী নেহেরু মুসলমান তোষণ করেছেন, এই নির্ভেজাল মিথ্যেগুলোর প্রচারও এখন সংবাদ মাধ্যমেই করা হচ্ছে, টোএন্টি ফোর ইন্টু সেভেন। এরপরে সেই মোক্ষম আওয়াজ, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, মুসলমানরা জনসংখ্যায় বেড়ে হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে, তখন হিন্দুদের জবাই করা হবে, অতএব সময় থাকতে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হন, মজার কথা হল এই নোংরা সাপ্রদায়িক প্রচারের হাতিয়ারও সেই সংবাদ মাধ্যম। কিন্ত সমস্যা হল এতকিছু বলার পরেও দেশের অধিকাংশ মানুষই এই প্রচারে কান দিচ্ছে না, বিজেপি এখনও ৪২/৪৪% এর বেশি ভোট পাচ্ছে না। এবং তার ওপরে অর্থনীতির সংকট তাকে সরকার বিরোধী করে তুলছে। কাজেই ঐ মেকি জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, উগ্র হিন্দুত্ব, মুসলমান সমেত সংখ্যালঘু বিরোধিতা দিয়ে আর চলছে না, চলবেও না। কাজেই নতুন রাস্তা হল এবার সমস্ত বিরোধীদের গায়ে কালি মাখাও। এইখানে একটা সুবিধে আছে, দীর্ঘদীন ধরে আমাদের দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রায় প্রত্যেক দলের মধ্যেই দূর্নীতিবাজ নেতারা আছেন, এবং তারসঙ্গেই দেশ জুড়ে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটা পারসেপশন একটা ধারণা তৈরিই আছে যে তাঁরা দূর্নীতিতে লিপ্ত। এই দুটো জায়গা থেকে বিজেপি সরকার তার প্রতেক সাংবিধানিক কাঠামোকে কাজে লাগাচ্ছে, সে সিবি আই হোক, ইডি হোক, বা এন আই এ র মত গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানই হোক, প্রত্যেককে কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলগুলোর কিছু দূর্নীতিগ্রদস্থ নেতাদের ধরছে, প্যারালালি কিছু ব্যবসায়ী সংবাদ মাধ্যমে রেইড করাচ্ছে, এবং ঐ দালাল, পেটোয়া, গোদি মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে সবকটা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এক লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে। একজন ধরা পড়লো, ধরা যাক, অনুব্রত মন্ডলের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী সায়গল। জানা গ্যালো ৩০ কোটি টাকার সম্পতি আছে, তারপর জানা গ্যালো আরও ৪ টে পেট্রল পাম্প আছে, তারপর জানা গ্যালো অসংখ্য জায়গায় জমি আছে। কী করে জানা গ্যালো? কে জানালো, যা জানা গ্যালো তার প্রমাণ? কিচ্ছু নেই। জানা গ্যালো মানে জানা গ্যালো। এখন জানা যাচ্ছে সায়গলের নাকি ১৫০ কোটি টাকা সম্পত্তি। যেমনটা মদন মিত্র কে গ্রেপ্তার করার পরে জানা গিয়েছিল, একটা চ্যানেলে ৮৮ কোটি, হ্যাঁ ৮০ নয়, ৯০ নয় এক্কেবারে ডেফিনিট, ৮৮ কোটি টাকা, বে আইনি টাকা পাওয়া গেছে জানিয়ে দেওয়া হল, তিনি প্রত্যেক ট্যাক্সির কাছ থেকে ৬০০০ টাকা নেন, তাঁর ৬ টা ফ্ল্যাট আছে, অসংখ্য বান্ধবী, একজনের আবার আত্মহত্যা, এসব জানা গ্যালো। সেই চ্যানেলেগুলোতে আজ একই ভাবে অনুব্রত মন্ডলের সম্পত্তি জানা যাচ্ছে, সায়গলের সম্পত্তি জানা যাচ্ছে, কিছুদিন পরে এসব চলে যাবে তখন ববি হাকিমের সম্পত্তির তালিকা দেখানো হবে। মদন মিত্রের সম্পত্তি আর বে আইনী টাকা নিয়ে আজ আর কোনও উচ্চ বাচ্য নেই, সেদিন অনুব্রত নিয়েও থাকবে না। মানে ই ডি, সি বি আই, ইনকাম ট্যাক্স গ্রেপতার করার পর দায়িত্ব নিচ্ছে এই মিডিয়া, কেউ শিরদাঁড়াহীন অথচ আশ্চর্য, চোখে চোখ রেখে নাকি কথা বলেন, কেউ সন্ধ্যে হলেই আপনি বলুন, আপনি বলুন, আপনি বলুন তারপর কলতলার ঝগড়াতে কিছু আরও গুজব ছড়িয়ে, দেখা হচ্ছে কাল বলে অনুষ্ঠান শেষ করছেন। আসলে এক নোংরা মিডিয়া ট্রায়ালের মুখে দাঁড়িয়ে দেশের বিরোধী দল। নদীর জলে ভাটা আসে, জল স্থির হয়ে যায়, গু গোবর ভাসতে থাকে, তখন দেখলে মনে হয় এই জলে চান? তারপর জোয়ার আসে, আসবেই। বান আসে, আসবেই, দুকুল ছাপিয়ে জলের প্রবাহ সব ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। এই মিডিয়া ট্রায়ালই শেষ কথা বলবে না, মানুষ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই কাজ করে। করবে। সংবাদ যে বাদ পড়েছে, তা মানুষ খেয়াল করছে, সংবাদের জায়গায় যে কিছু হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং দাঁড়িয়ে আছে, তাও মানুষ বুঝে ফেলেছে, বান আসছে, এসব নকড়া ছকড়া সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যম ভেসে যাবে, যাবেই।