কোথাও হাতে গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা, বিরোধী দলের কেউ আসলেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে একগাল হেসে বলছেন, যান নমিনেশন ফাইল করে আসুন। সে এক দৃশ্য, অতএব তা মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে। গতকাল তো ঘেমেনেয়ে দিলীপ ঘোষ হাজির হতেই তাঁকে আগে ওআরএস দেওয়া হয়েছে। একটু জিরোন, তারপর মনোনয়ন পেশের তদ্বির করবেন, তিনিও জল খেয়ে খানিক খেজুরে আলাপ সেরে নেমে পড়লেন কাজে। কিন্তু চিত্র তো কেবল এটাই নয়, কোমরে গোঁজা পাইপগান নিয়েও হাজির ছিল উন্নয়ন, হাজতে ঠাঁই হয়েছে, লাঠি আর মানুষ নিয়ে ব্লক অফিস ঘিরে রাখার ব্যাপারেও খুব পিছিয়ে নেই তৃণমূল। অতএব ঝাড়পিট হচ্ছে। তবে সেটা আক্ষরিক অর্থেই মারামারি, ২০১৮-র মতো পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়, এবার অন্তত পাঁচ ছ’টা পকেটে মারামারি হয়েছে দু’ পক্ষের মধ্যে। তার মধ্যে আছে ভাঙড়, ডোমকল, ক্যানিং, বর্ধমানের শক্তিগড়, বাঁকুড়ার ইন্দাস আর বীরভূমের সাঁইথিয়া। খেয়াল করুন, এসব হচ্ছে কিন্তু মূলত দক্ষিণবঙ্গে এবং কোনও একটা নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে নয়, বীরভূম আর বাঁকুড়াতে বিজেপি বনাম তৃণমূল, ডোমকলে কংগ্রেস বনাম তৃণমূল, ভাঙড়ে আইএসএফ বনাম তৃণমূল, শক্তিগড়ে সিপিএম বনাম তৃণমূল আর ক্যানিংয়ে সেমসাইড, তৃণমূল বনাম তৃণমূল। মানে রাজ্যজুড়ে গণতন্ত্রের এই উৎসবে লাঠি, পাইপগান, বোমা, গোলাপ ফুল, ওআরএস সবই আছে, এবং এখনও পর্যন্ত খবর, সবটাই তৃণমূল দলের দামাল ছেলেদের কাণ্ড। গতবারের মানে ২০১৮-র থেকে ২০২৩-এর নির্বাচনের দুটো ফারাক সামনে, এবার কিছু আশ্বাস মিলেছে তৃণমূলের তরফে, নিশ্চিন্তে মনোনয়ন দিন, কিন্তু তারপরেও বেশ কিছু জায়গায় ঝামেলার শুরুয়াত তৃণমূল দলের তরফেই। দু’ নম্বর ফারাক হল ওই গোলাপ আর ওআরএস-এর গল্প গতবারে ছিল না, এবার তা নতুন সংযোজন। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে। কোথাও গোলাপ, কোথাও ঠান্ডা জল কোথাও লাঠি হাতে তৃণমূল।
রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না আহা। প্রতিটা ব্লকে শাসকদল হাজির থাকবে ওআরএস আর গোলাপ নিয়ে, ধামসা মাদল বাজবে, ও ননদি আর দু’ মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে, গান হবে। পান খেয়ে পিচিক পিচিক থুতু ফেলে প্রার্থীরা মনোনয়ন সম্পূর্ণ করে বাড়ি ফিরবেন। এমনটা কি হতে পারে না? না, হওয়া সম্ভব নয়। কারণটা একটু আলোচনা করা যাক। অন্যান্য রাজ্যে এমএলএ, এমপি, পঞ্চায়েত প্রধান, সমিতি বা জেলা পরিষদ সদস্য, কর্পোরেশন বা মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলরদের দুর্নীতি আর সম্পদের বহর দেখলে চোখ কপালে উঠবে। তাদেরকে ঘিরে একট ছোট্ট কোটারি থাকে, কিছু গুন্ডা মাস্তান তাঁরা পোষেন, তারাও কিছু ভাগ পায় বইকী। কিন্তু আমজনতার সঙ্গে সেই ক্ষমতা আর ক্ষমতার থেকে চুঁইয়ে পড়া মধুভাণ্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। আর এটাই আমাদের এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজারের গুমটিতে ছোট্ট মোবাইল রিপেয়ারিং শপ থেকে সবজির দোকান, পাম্প সারাই মিস্ত্রি থেকে পরামানিক, প্রান্তিক কৃষক, যার কৃষক সমিতি থেকে একটু কম দামে বীজ বা সারের দরকার হয়, এই প্রত্যেকের, প্রত্যেকের অস্তিত্ব জড়িয়ে থাকে শাসকদলের সঙ্গে। যারা সেই ভাগ পায় না তারা বিরোধী, সে যে দলই হোক না কেন।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত ভোটে বামেরা মাঠে, বিজেপি কোর্টে
মানে প্রতিটা গরিবস্য গরিব মানুষের রোজগারও জড়িয়ে আছে শাসকদলের কাছে তার আনুগত্যের উপর। সেই শাসকদল থাকলে তার পেট চলবে, অতএব পেট বাঁচানোর জন্য দুটো বোমা ছোড়া, লাঠি দিয়ে মাথা ফাটানো কোনও শক্ত কাজ নয়। অন্যদিকে যদি ক্ষমতায় আসি তাহলে ওই মধুভাণ্ড আগামী ৫ বছরের জন্য দখলে থাকবে, অতএব জান কবুল লড়ে যাও। এ লড়াই বাংলার গ্রামে, শহরে, মফস্সলে। এমনভাবে রাজনীতিকে পেট চালানোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ছবি আর কোথাও নেই। কাজেই প্রতিটা ভোটের জন্য, প্রতিটা আসনের জন্য, প্রতিটা মানুষের লড়াই চলছে চলবে। এই তীব্র প্রতিযোগিতার বহিঃপ্রকাশ শাসকদল আর বিরোধীদের মারামারিতে। আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম নির্বাচনের সময় এই মারামারি কি আসলে ক্ষমতার পেছনে থাকা টাকা রোজগারের জন্যই হয়? নাকি এই মারপিটের সঙ্গে কোনও আদর্শ জড়িয়ে আছে? আসুন শুনে নিই, মানুষ কী বলছে।
বাসন্তীর এক সিপিএম প্রার্থীর শ্বশুরমশাই জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন বউমাকে পঞ্চায়েতে জেতানোর জন্য, হুগলির এক তৃণমূল প্রার্থী নিজের টোটো বেচে দিয়েছেন নির্বাচনের খরচ জোগানোর জন্য, বিজেপির বা কংগ্রেসেরও এমন নিশ্চই আছে। কিন্তু এটা কি ইনভেস্টমেন্ট? একবার জিতে গেলে আবার জমি হবে, আবার টোটো কেন মারুতি ভ্যান হবে, এটাই কি আসল সত্য নয়? গান্ধী দেখেছিলেন গ্রাম সুরাজের স্বপ্ন, গ্রামের মানুষজন নিজেদের সাসটেনেবল ইকোনমি তৈরি করবে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে গ্রাম, পঞ্চায়েত কেবল রাজনীতির নয় সমাজের হাল ধরবে। সন্ধেয় প্রার্থনাসভা হবে, ইশ্বর আল্লা তেরো নাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান। জাতির পিতার সেসব স্বপ্ন থেকে বহু বহু সহস্র মাইল দূরে আপাতত লাঠি পাইপগান বোমা গোলাপ আর ওআরএস-এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বংলার রাজনীতি, বাংলার গ্রাম।