দুটো রাজ্য, দিল্লি মিউনিসিপালিটি, বিভিন্ন রাজ্যে উপনির্বাচনের ফলাফল সামনে এল। রাজার ভেঁপুবাদকেরা ঢোল, কাড়া-নাকাড়া, যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রাজার জয়জয়কার করেই চলেছে। উত্তেজনায় এক মোসাহেব অ্যাঙ্কর তো হিমাচল প্রদেশেও ভাজপার বিপুল জয়ের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিল। টিভি চ্যানেল দেখে মনে হচ্ছে একটিই রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে, গুজরাতে। এবং সেখানে মোদি মোদি মোদি চলছে। ওদের আর দোষ দিয়ে কীই বা হবে বলুন, চ্যানেল মালিকের রোজগার আসে চ্যানেল থেকে নয়, কাজেই তাদের টিকি বাঁধা। সেই সব মালিকের নির্দেশে পুতুলনাচের ইতিকথা চলছে চ্যানেলে চ্যানেলে। মাস মাহিনা যে স্নেহ অপেক্ষাও বিষম ব্যাপার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকলে বুঝতেন। বিজেপি কার্যালয়ে ঝাড়া এক ঘণ্টা অনর্গল স্বভাবসুলভ ভাবেই মিথ্যে বলে গেলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশ তরক্কি পর হ্যায়। ২০১৪তে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স ছিল ৫৫তে, এখন ১০৭। প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স ছিল ১৪০-এ এখন ১৫০। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স ছিল ১১৭তে এখন ১৩৬। করাপশন পার্সেপশন ইন্ডেক্স ছিল ৩৬, এখন ৮৫। হেনলে পাসপোর্ট ইন্ডেক্স, মানে আপনার পাসপোর্ট কত দেশে কতটা গ্রাহ্য, ভিসা ছাড়াই ঢোকা যায় কি না ইত্যাদির ভিত্তিতে ২০১৪তে ৭৬, এখন ৮৫। ফুড সিকিউরিটি ইন্ডেক্স ১৫ পয়েন্ট, ছিল ৫৬, হয়েছে ৭১। জিডিপি কমছে, এসব কিছুই নাকি সত্যি নয়, উনি বলেই চলেছেন দেশ তরক্কি পর হ্যায়, পেছনে তারস্বরে হুক্কা হুয়া। কিন্তু খেয়াল করুন, হিমাচল হাত থেকে গেছে, দিল্লি মিউনিসিপালিটি হাত থেকে গেছে, উপনির্বাচনে খতৌলির হার কম নয়, মৈনপুরিতে সমাজবাদী পার্টির রেকর্ড, কিন্তু দেশের প্রত্যেক কোনায় পৌছে গেলেন মোদিজি, জয়োৎসব হল। কেজরিওয়াল দিল্লি জিতেছেন, গুজরাতে ১২-১৩ শতাংশ ভোট, সাংবাদিকদের ডেকে বললেন কিল্লা টুট গয়া, এবার দুর্গ জয় করব। বিজেপিকে হারাব। ওদিকে হিমাচলে স্বচ্ছন্দ জয়, ৬৮তে ৪০টা আসন, কম কথা নয়। কংগ্রেস দফতর শুনশান। তারাও ঢোল কাড়া-নাকাড়া নিয়ে নাচতে পারত, লাড্ডু খাওয়াতে পারত। ৪ বছর পরে কংগ্রেস কোনও রাজ্যে এককভাবে জয় পেল। ও মা, কোথায় কী, কেবল প্রবক্তারা চ্যানেলে চ্যানেলে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। ২-১ গোলে হেরে মোদিজি বডি ল্যাঙ্গোয়েজ আলেকজান্ডারের মতো, ৪ বছর পরে একক জয় পেল কংগ্রেস। সামনে ছিলেন ভূপেশ বাঘেল, রাজীব শুক্লা, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তাঁদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ হেরো হারানের মতো। সে যাই হোক না কেন, ২০২২-এর ডিসেম্বরের এই ফলাফল কিন্তু ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে, এবং তার আগে কর্নাটক, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, তেলঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবেই। বিজেপি গুজরাতের ফলাফলে উজ্জীবিত, তারা চেয়েছিল কংগ্রেস হারুক কিন্তু আপও যেন বিরাট কিছু না করতে পারে, তাদের সব ইচ্ছেই পূরণ হয়েছে। মোদি ম্যাজিকে কংগ্রেস হেরেছে, আপ তেমন কিছুই করে উঠতে পারেনি। কিন্তু ২০২৪-এ গুজরাতে তাদের পাওয়ার কীই বা আছে? গত লোকসভার নির্বাচনে গুজরাতে বিজেপি ২৬-এ ২৬। কাজেই এবারে ২৬ পেলেও নতুন কিছু হবে না। কিন্তু হিমাচল? কংগ্রেস যদি আগামী দেড় দু’বছর এক গুড গভর্নেন্স দিতে পারে? তাহলে ৩ বিজেপি, ১ কংগ্রেসের বদলে ফলাফল উল্টোও হতেই পারে, মোদ্দা কথা ১টা হলেও কমতে পারে। দিল্লিতে ২৪-এও সাতে সাত, নাও হতে পারে। মানে এই তিনটে নির্বাচনের ভোট লোকসভার প্রেক্ষিতে দেখলে গুজরাত বিজেপি ২৬-এ ২৬, কিন্তু হিমাচলে ১টা আর দিল্লিতে ৩টে আসন পাবে, মানে মোট ৭টা আসন হারাবে বা হারাতে পারে। আরেকটা বিষয়ে বিজেপির সমস্যা খুব ধীরে হলেও মাথাচাড়া দিচ্ছে, আগামী নির্বাচনগুলোতে সেই সমস্যা আরও বড় হবে। তা হল দলে বিদ্রোহ, দলে অসন্তোষ। যা গুজরাতে খুব কম দেখা গিয়েছে, তারও কম প্রভাব পড়েছে, কিন্তু হিমাচলে এই বিদ্রোহীরা বেশ কিছুটা ক্ষতি করেছে। স্বয়ং নাড্ডাজি, দলের সভাপতির রাজ্য, কিন্তু এই বিদ্রোহ তিনি সামাল দিতে পারেননি। মোদিজিকেও শেষে নামতে হয়েছে, কন্তু গুজরাতে যে প্রভাব মোদিজির আছে, সেই প্রভাব তো হিমাচলে নেই। এর পরে যে নির্বাচন আসছে সেখানে আরও বেশি ঝামেলা। রাজস্থানে মাস লিডার বসুন্ধরা রাজে, কিন্তু তিনি হাই কমান্ডকে পাত্তাও দেন না, সেখানে তিনটে বড় গোষ্ঠী। মধ্যপ্রদেশে সিন্ধিয়া আর মামাজি, মানে শিবরাজ সিং চৌহানের সম্পর্ক সাপে নেউলে। কর্নাটকে নির্বাচন, সেখানে ইয়েদুরিয়াপ্পাকে দলের সর্বোচ্চ কমিটিতে জায়গা দিলেও এই লিঙ্গায়েত নেতা, তাঁর সমর্থকরা নাখুশ, তারা বোম্মাইকে মেনে নিতে পারছে না। ছত্তিশগড়েও একই দশা। এই অন্তর্কলহের জন্য দায়ী মোদি–শাহ। তাঁরা নেতা ঠিক করে দিচ্ছেন, কাঠপুতুলের মতো নেতা, গুজরাটে ভূপেন্দ্র প্যাটেল, কর্নাটকে বাসবরাজ বোম্মাইয়ের মতন নেতা। এদের কথা স্থানীয় নেতারা পাত্তা দিচ্ছে না, দেবেই বা কেন? গুজরাতে মোদিজি বললেন, ১৮২টাতেই আমিই প্রার্থী, গুজরাত মেনে নিল, একই কথা বললেন হিমাচলে, হিমাচলবাসী মেনে নিল না। কর্নাটকে মানবে? রাজস্থানে মানবে? মধ্যপ্রদেশে মানবে? মনে হচ্ছে না। এবং এই তুরুপের তাস কতবার সফল হবে? এক মোদি ছাড়া বিজেপির অন্য অস্ত্র কোথায়? তৃতীয় সমস্যা হল কংগ্রেসের পরিসর কমে আসা। কংগ্রেস হচ্ছে বিজেপির কাছে প্রাকটিসের পাঞ্চিং ব্যাগ, দে দনাদ্দন দে দনাদ্দন। অন্য কারও মুখে পড়লেই বিজেপিকে অসহায় দেখাচ্ছে, সে আপ হোক, তৃণমূল হোক, টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে যেই হোক না কেন, গোবলয়ের বাইরে রিজিওনাল দলের সামনে বিজেপি দাঁড়াতে পারছে না। কাজেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত বিজেপির কাছে অন্য সমস্যা খাড়া করছে। এবারে আসুন আপ-এর দিক থেকে ভাবা যাক। দিল্লিতে জয়, ভাল জয়, ১৫ বছর পরে বিজেপির হাতছাড়া দিল্লি মিউনিসিপালিটি। কিন্তু মণীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈনের আসনে তাদের হার চমকে দেওয়ার মতো। মানে তাদের ওপরে দুর্নীতির অভিযোগ কিছুটা হলেও মানুষ গিলেছে। কিন্তু এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইই তো আপকে রাজনীতির সেন্টার স্টেজে দাঁড় করিয়েছে। ওদিকে গুজরাতের ফলাফল আধাখ্যাঁচড়া, ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে একটা আসনও না পেলেও চলত, কিন্তু ১২ শতাংশ ভোট আর ৫টা আসন দাগ কাটল না, উলটে আগামী দিনগুলোতে ওই ৫ জনকে নিজেদের খাতায় রাখাটাই আপ-এর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। গুজরাত ভোটের পরে টেকনিক্যালি আপ জাতীয় দল হল বটে, কিন্তু ২০২৪-এ মোদি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে একমাত্র বা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জার আপ? না এটা হল না। বরং আপ ভোট কাটতেই বাজারে নেমেছে, এই ন্যারেটিভটা কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য হল। তারা এরপর যখনই কর্নাটক বা রাজস্থানে যাবে, তাদের ভোটকাটুয়া বলার লোকের অভাব হবে না, তা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যও হবে। গুজরাত প্রচারের সময় নিজেদের যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল আপ, তা ছিল এক ওভারহাইপড অ্যাসেসমেন্ট, তার খেসারত আপকে গুজরাতে শুধু নয় জাতীয় রাজনীতিতেও দিতে হবে। দিল্লিতে মুসলমান ভোট সরে যাওয়াটাও আগামিদিনে এক সমস্য হয়ে দাঁড়াবে। এবার গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির কথা বলা যাক। কংগ্রেসের ভারত জোড়ো যাত্রা, সত্যিই এক জরুরি কাজ, কংগ্রেস ফিরে পাক তার হারিয়ে যাওয়া সেন্টার টু লেফট, উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, জনকল্যাণকর অবস্থান। যা তারা ৭০ থেকেই ক্রমশ হারিয়েছে। তা ফিরে পাওয়া সহজ? একটা দক্ষিণ থেকে উত্তর, একটা পূর্ব থেকে পশ্চিম পদযাত্রা করলেই সেই অবস্থান ফেরত পাওয়া যাবে? না যাবে না। কারণ এই অবস্থান গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম থেকে। গতকাল নরেন্দ্র মোদি অনেক মিথ্যের মধ্যে একটা সত্যি কথা বলেছেন, বলেছেন আমাদের পাঁচ দশকের লড়াই, জনসঙ্ঘের সময় থেকে লড়াই আমাদের স্ট্রাগল, আমাদের আজকের এই বিজয়কে এনে দিয়েছে। উনি ভাল করেই জানেন আরএসএস–হিন্দু মহাসভা-জনসঙ্ঘ–বিজেপি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই লড়েনি। লড়েছে কংগ্রেস। কিন্তু ৭০ থেকে সে তার অবস্থান পাল্টাতে থাকে, সেই পরিবর্তনই বিজেপির আজকের সাফল্যের চাবিকাঠি। সেই উদার, জনকল্যাণকামী, ধর্ম নিরপেক্ষ, সেন্টার টু লেফট অবস্থান কংগ্রেসকে ফিরে পেতেই হবে। তা পেতে গেলে ভারত জোড়ো যাত্রা যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি নির্বাচনের সাফল্য। চার বছর পরে তারা সেই সাফল্য পেল। ছোট হলেও একটা রাজ্য তারা জিতেছে। কর্নাটকের লড়াইয়ের আগে এই জয় বিরাট গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সমস্যা এবং সম্পদ দুই হল গান্ধী পরিবার, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, সোনিয়া। কংগ্রেস কর্মীদের ১০০ জনের ১০০ জন বিশ্বাস করে মল্লিকার্জুন খাড়গে একজন দুধুভাতু সভাপতি। যেমন জে পি নাড্ডা। কিন্তু বিজেপির মোদি–শাহ আছে, কংগ্রেসের সেটা কই? রাহুল পদযাত্রায় থাকবেন? বেশ তো, নির্বাচনের প্রচারে কে থাকবেন? সেটা ঠিক হোক। কংগ্রেসের অবস্থা খানিক মার্কসের সেই ক্লাসিকাল সর্বহারাদের মতন, হারানোর আর কিচ্ছু নেই, জেতার জন্য রয়েছে সারা ভারত।