আমার দিব্য মনে আছে, আপনাদেরও মনে আছে নিশ্চয়ই। অব কি বার দো শ পার, বলার পরে ২০২১-এ বাংলায় বিধানসভার ভোট গণনার দিনে বিজেপি ৫০-এর পর থেকে সিঙ্গলসে রান নিচ্ছিল, সংখ্যা উঠছে আর না। ওদিকে সাঁ সাঁ করে উঠছে তৃণমূলের ট্যালি, ২০০ ধরে ফেলেছে। ছবি পরিষ্কার, কং-বাম-আইএসএফ এর জোট মাঠে মারা গেছে, বিজেপি ২০০ তো দূরস্থান, ৭০ পার করবে? হেস্টিংসের নয়া বিজেপি অফিসের ভিড় পাতলা হচ্ছে। কিন্তু কালীঘাটও উচ্ছ্বাসে ভাসছে না, চোখ রয়েছে নন্দীগ্রামের দিকে। এক বিজেপি নেতা বলেছিলেন, হেরে যাই, ৫০-৬০ টা আসন পাই, ঠিক আছে, কিন্তু নন্দীগ্রাম না পেলে দল ভেসে যাবে। তৃণমূলের বড় নেতা বলেছিলেন, জয় অসম্পূর্ণ থাকবে যদি নন্দীগ্রামে দিদি না জেতে। অভিযোগ যাই থাক, ফলাফল আমরা জানি। আমরা এও জানি যে আবার ২০২৬-এ প্রত্যেকের নজর থাকবে ওই নন্দীগ্রামের দিকে। তাই নন্দীগ্রাম মানেই ছলকে ওঠা রক্ত, বাড়তে থাকা রক্তচাপ। এই নন্দীগ্রাম বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিয়েছে সেই কবেই। এই নন্দীগ্রাম আবার তৃণমূলের বিরাট সাফল্যের দুধে এক ফোঁটা চোনা হয়ে টুপ করে ঝরে পড়েছে। কাজেই জনজোয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণে এল, দলের নতুন রক্তকে বোঝার চেষ্টা করলেন যুবরাজ। কিন্তু এতদিন পরে পাল্টা রোড শো-র হাঁক দিলেন শুভেন্দু অধিকারী, কাঁথির খোকাবাবু। কেন? কারণ সেই নন্দীগ্রাম। স্বাভাবিকভাবেই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, জনজোয়ারের চাপে শুভেন্দু অধিকারী।
আসলে অন্য রাজ্যে, বা বলা ভালো উত্তর ভারতের গোবলয়ে বিজেপির একটা সুবিধে আছে। সেখানে ধর্মের কড়া পাক বা নরম পাককে যেমন ইচ্ছে তেমন করে মিলিয়ে নেওয়া যায় রাজনীতির সঙ্গে। হিন্দু খতরে মে হ্যায় বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানের ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষের বুক ছলাৎ করে ওঠে। ঘরে দানাপানি আছে কি না, ছেলেমেয়ের চাকরি আছে কি না, বাজারে জিনিসের দাম বাড়ছে না কমছে সেসব বিচারের আগে নিজের হিন্দুসত্তা সামনে এসে দাঁড়ায়। আতিক আহমেদ গুলিতে মরলে এত আনন্দ পায় যা ছেলের হাতে সরকারি নোকরির অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারের সমান। আমাদের বাংলায় সেটা হয় না। সেই কবে হিন্দু মহাসভার মিছিলে বেদম ইট ছুড়ে মিছিল ভন্ডুল করে দিয়েছিল নেতাজি সমর্থকেরা। নেতাজি বলেছিলেন, ওই ত্রিশূল সন্ন্যাসীদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
আরও পড়ুন: Aajke | পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই গাজর ঝোলানো হল, দেড় লক্ষ চাকরি
কাজেই আমাদের বাংলার মাটিতে শুভেন্দু অধিকারী যতই লম্বাচওড়া গেরুয়া উত্তরীয় আর মাথায় ফোঁটা কেটে বের হন না কেন, কেবল ওই ধর্ম দিয়ে সমর্থন জোগাড় করতে পারবেন না। এক অসম্ভব মেরুকরণ আর বিরাট প্রচারের জোরে সেদিন কিছু আসন জিতেছেন বটে কিন্তু প্রতিদিনই বুঝতে পারছেন, পায়ের তলা থেকে মাটি খসে যাচ্ছে, সমর্থন চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে অভিষেকও বুঝেছেন, এই নন্দীগ্রামের মাটি থেকে শুভেন্দুকে সরাতে পারলে অর্ধেক লড়াই শেষ। কাজেই আপাতত বাংলার রাজনীতির গ্রাউন্ড জিরো আবার সেই নন্দীগ্রাম। কিছুদিন আগে মমতা হেরেছেন, অভিষেক মঞ্চে দাঁড়িয়েই থাপ্পড় খেয়েছেন, এবার জমি ফিরে পাবার লড়াইয়ে, সেই গ্রামেই রাত্রিযাপন, সেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মন কি বাত, সেই গ্রামকে ঘিরেই জনজোয়ার। কাজেই রাজনৈতিক তাপমান এবং চাপ তুঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীও ঘোষণা করে দিলেন ১৬ তারিখে ওই নন্দীগ্রামেই মিছিল। একেই বলে চাপ। তাহলে কি জনজোয়ারের চাপেই মিছিলে নামছেন শুভেন্দু অধিকারী? মানুষকে সেই প্রশ্ন করেছিলাম। ওনারা কী বললেন শোনা যাক।
সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে মাথায় রেখেই এক বিরাট জনসংযোগ যাত্রায় নেমেছে তৃণমূল। তৃণমূলের জনজোয়ারে শুদ্ধিকরণ কতটা হবে, কতটা হওয়া সম্ভব এসব প্রশ্ন আদতেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল দলের মধ্যে ফাঁকফোকর কতটা বোজাতে পারলেন অভিষেক? এ নেতার সঙ্গে ও নেতার সাপে-নেউলে সম্পর্কের কতটা শোধরানো গেল? কারণ মমতাও জানেন, অভিষেকও জানেন, বিরোধী এখনও কংগ্রেস বা সিপিএম নয়, কিন্তু এই দুই দল মিলে তৃণমূল বিরোধী ভোটের এক বিরাট অংশ কাটলে আখেরে লাভ তৃণমূলের এবং বিজেপির রাজ্য সংগঠনের যা অবস্থা তাতে কেবল সংগঠনটা ধরে রাখলেই তৃণমূলের কেল্লা ফতে। অভিষেক সেই কাজে মন দেওয়ার পরেই রক্তচাপ বেড়েছে অন্তত শুভেন্দুর কারণ তিনি জানেন মমতার মাটির লড়াই। সামনের পঞ্চায়েত যার হাতে থাকবে সে নিশ্চিত আগামী নির্বাচনগুলোতে অ্যাডভান্টেজ পাবে। কাজেই আজ আমরা অভিষেকের জনজোয়ার দেখছি কাল সেই জনজোয়ার পৌঁছবে নন্দীগ্রাম, ১৬ তারিখ সেখানেই জমি আঁকড়ে বসে থাকার জন্য রাস্তায় শুভেন্দু অধিকারী। চাপ বাড়ছে, চাপ বাড়ছে। মাথার ওপর মমতাকে নিয়ে রাস্তাতে থাকা এক জিনিস, মমতার বিরুদ্ধে রাস্তায় থাকাটা কঠিন, খুব কঠিন।