হুজুর মাই বাপ নির্দেশ দিয়েছেন, ৫ অগস্টের ঘেরাও অভিযান বন্ধ, স্থগিত। মুখ বাঁচাতে তৃণমূল নেতা তাপস রায় বিধানসভায় এখন ব্লকে ব্লকে অবস্থান বিক্ষোভ আয়োজনের কথা বলেছেন। আদালতের নির্দেশ ভুল না ঠিক, তা নিয়ে চুলচেরা বিচার তো আইনজ্ঞরাই করতে পারেন, আমরা তো বিচারককে চিরটাকাল গণতন্ত্রের সেকরেড কাউ, পবিত্র গাভী হিসেবেই জেনে এসেছি, যাকে জবাই করা যায় না। কাজেই নির্দেশ নিয়ে একটা কথাও বলব না। আসুন ঘেরাও নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে এই ঘেরাও শব্দটা ঢুকেছিল মধ্য ষাটে। আসলে তখন দ্য স্টেটসম্যান থেকে শুরু করে অমৃতবাজার ইত্যাদি ইংরিজি পত্রিকাতে ঘেরাও শব্দের যুৎসই ইংরিজি না খুঁজে পেয়ে ওই ঘেরাওই লেখা হতে থাকে, তারপর সেটা ইংরিজি শব্দ হিসেবেই অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে জায়গা পেয়ে যায়। যুক্তফ্রন্টে এসইউসিআই নেতা সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো বলাই হত ঘেরাও মন্ত্রী। হ্যাঁ, তখন হুট বলতে ঝুট ঘেরাও হত, আর যুক্তফ্রন্টের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ঘেরাও তুলতে পুলিশ যেত না, কাজেই কলেজ থেকে অফিস থেকে কারখানা ঘেরাও চলত, সে ঘেরাও ৭-৮ দিন পর্যন্ত চলেছে। তারপর সে সব লড়াইয়ের দিন গেছে, কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘেরাও তো বাদই দিলাম, হরতালেও লজ্জা পেয়েছেন। বহুদিন পরে সেই ঘেরাও প্রসঙ্গ আমাদের সামনে এল ২১ জুলাই। তৃণমূল যুবরাজ বললেন নেত্রীর অনুমতি নিয়েই আমি ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা করছি, বঞ্চনার প্রতিবাদে বিজেপি ছোট সেজো, মেজো, বড় নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করবে আমাদের কর্মীরা। একটু পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেজে উঠেই কর্মসূচি শুধরে দিলেন, বাড়ির থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে শান্তিপূর্ণ ঘেরাও, যাতে বাড়ির লোকজনদের অসুবিধে না হয়। সেটাই বিষয় আজকে, ৫ আগস্টের ঘেরাও স্থগিত, আদালতের নির্দেশে।
এই ঘেরাও কেন? সাতসকালে উঠে মানুষের মনে হল চল ওঁকে ঘেরাও করি, এমন তো নয়। আমার হকের জন্য লড়াই, আমি বার বার করে বলব আমার দাবির কথা, বেকারেরা বলবেই চাকরির কথা, কৃষকরা বলবে কম দামে সার, সেচ আর বীজের কথা, তারা বলবেই ফসলের ন্যায্য দামের কথা, শ্রমিকেরা বলবে মজুরির কথা, তার কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার কথা, তার অবসরের পরে প্রাপ্যর কথা। কিন্তু কেবল বলে যাবে? কেউ যদি না শোনে? তাহলে?
আরও পড়ুন: Aajke | মালদা আর মণিপুর
হ্যাঁ, এইখান থেকেই ঘেরাও উঠে এসেছিল, আমার হকের জন্য লড়ছি, কানে না ঢুকলে ঘেরাও করব, এক জায়গায় বসিয়ে রাখব। হ্যাঁ, সেটাই হয়েছিল ৬৫-৬৬-৬৭-৬৮তে। শ্রমিকেরা মজুরির দাবিতে ঘেরাও করেছিল, আতঙ্কিত মালিক দিন গুনতেন কবে ঘেরাও হবেন তাঁরাও। তারপর এমনকী কমিউনিস্ট আমলেও পুলিশ গুলি চালাল কৃষকদের বুকে, এমনকী সরকার গরিব কৃষকের জমি কেড়ে শিল্পপতিদের দেওয়ার পরিকল্পনা করল, প্রতিবাদ হল, কিন্তু সুযোগ বুঝে প্রতিবাদের অস্ত্র ঘেরাও, স্ট্রাইক, হরতাল উবে গেল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। মাত্র ক’দিন আগে আবার সেই ঘেরাও ফিরে এল। কেন? গরিব মানুষ, গ্রামের মানুষ কাজ করেছেন, ১০০ দিনের কাজে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের টাকা তাঁরা পাচ্ছেন না, অজুহাত হিসেব মিলছে না। অজুহাতই বটে, তিন তিনবার রাজ্য ১০০ দিনের কাজের রেকর্ডে দেশে প্রথম, অথচ হিসেব মিলছে না? বিরোধী নেতা বলছেন বলে দিয়েছি, টাকা আসবে না? কার বাপের টাকা কে দেয়? আমাদের ট্যাক্সের টাকা গেছে কেন্দ্রে, আমাদের জন্যই তা খরচ হবে, তা আটকানোর কোনও অধিকার নেই দিল্লির সরকারের, বিরোধী দলনেতা যা বলেছেন তা পেটে মারার হুমকি। কীভাবে প্রতিবাদ হবে? দিল্লি চলো দোসরা অক্টোবর, বেশ সে যখন হবে তো হবে, এখানে কী হবে? যাঁরা বিজেপি করেন, বিজেপির নেতা, তাঁদের দায় নেই? রাজ্যের মানুষ প্রাপ্য টাকা পাচ্ছে না, রাজ্যের বিরোধী নেতাদের দায় নিতে হবে না? তাদেরকে তো উত্তর দিতে হবে, কারণ তাঁরাই তো দিল্লির সরকারে আছেন, সেই জবাবদিহি তো দিল্লিতে হবে না, বাংলায় হবে, আজ হবে না তো কাল হবে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ মুখ খুলবেই, প্রতিবাদ করবেই। আমরা সেই প্রশ্নই মানুষকে করেছিলাম, ১০০ দিনের টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র, মানুষ ঘেরাও, মিছিল, অবস্থান, বিক্ষোভ করবে না? মানুষ তার হকের অধিকারের জন্য লড়বে না? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
মানুষ তার হকের লড়াই লড়বে। বেকার তার চাকরির জন্য লড়বে, কৃষক তার ফসলের দামের জন্য লড়বে, শ্রমিক তার মজুরির জন্য হরতাল করবে। এবার সেগুলো যদি আদালতের রায়েই হয়ে যেত, যদি আদালত রাজ্যের ১০০ দিনের কাজ করা মানুষের পয়সা পাইয়ে দিত, বেকারদের চাকরি করে দিত, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করত, তাহলে তো কোনও কথাই ছিল না। কিন্তু সেই দায় না নিয়ে, আদালত যদি কেবল হরতাল, ঘেরাও, অবস্থান, বিক্ষোভ, মিছিলের ব্যাপারেই তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিতেই থাকেন, তাহলে হুজুর মাই বাপ আমি কোনও কথা বলব না কিন্তু দুষ্টু লোকে বলবেই, ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। সেইটা যদি হুজুর মনে রাখেন, তাহলে ধন্য হই।